
উপজেলা পরিষদ আইনে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, স্থানীয় পর্যায়ে ১৭টি বিভাগ উপজেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতার বিরোধ বেড়েছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভাগের সচিবরা এসব দপ্তরের কাজ বাস্তবায়নে উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সভাপতি করে পরিপত্র জারি করায় এ দুই পদে দায়িত্বশীলদের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়েছে। এই পরিপত্র অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রায় সব কাজে দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা উপদেষ্টা হওয়ায় উপজেলা পরিষদে কার্যত তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তা উপজেলা পরিষদ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ফলে জটিলতা আরও সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদের বদলে উপজেলা প্রশাসন নাম উল্লেখ করছেন। এমতাবস্থায় উপজেলা পরিষদ আইনের যে বিধান, তা অকার্যকর হতে চলেছে।
বিষয়টি গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণেই হাইকোর্টে রিট করা হয়। হাইকোর্ট এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ দিয়েছেন, উপজেলা পরিষদের অধীন ন্যস্ত নির্দিষ্ট বিভাগগুলোর কার্যক্রম পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে বিধিবিধান অনুসারে করতে হবে। এই কলামেই অতীতে লিখেছিলাম, স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরগুলোর ভিত যেখানে শক্তিশালীকরণের জনদাবি দীর্ঘদিনের, সেখানে বিভিন্ন সময় নানা কৌশলে দুর্বল কিংবা নিষ্ফ্ক্রিয় করার যে চেষ্টা দেখা যায়, তা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার জন্য অশুভ ফল ডেকে আনছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রত্যক্ষভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তৃণমূলের জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারাই ভালো বুঝবেন বা জানবেন এলাকার জনগণের সমস্যা-সংকটসহ তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদার কথা। তাছাড়া জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতাও রয়েছে। স্থানীয় জনগণ সরকারের প্রদেয় সহায়তা কিংবা স্থানীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রিতিনিধিরা যথাযথ ভূমিকা রাখার পথ প্রতিবন্ধকতামুক্ত হবে- এমনটিই কাঙ্ক্ষিত।
আমরা ক্রমাগত বলে আসছি, আমাদের আদি ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রতিটি স্তর শক্তিশালী করেই স্থানীয় উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা দরকার। উপজেলা পরিষদে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম চলছে- এ অভিযোগ নতুন নয়। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই ক্ষমতার প্রয়োগও যথাযথভাবে বা এখতিয়ারের মধ্যে থেকে করেন না- এও বহুল উচ্চারিত। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানদের অবস্থা আরও দুর্বল। আবার এও দেখা গেছে, নির্বাচিত কোনো কোনো উপজেলা চেয়ারম্যান দাপ্তরিক বা বিভাগগুলোর কাজও তেমন বোঝেন না। এ কারণেও অন্যদের সুযোগ নেওয়ার পথ সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা যে এখতিয়ারের প্রশ্ন তুলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হলেন, তা তাদের করতে হতো না যদি সরকার নির্মোহ অবস্থান নিয়ে উপজেলা পরিষদের বিধান মেনে বিদ্যমান সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিত। এখন হাইকোর্টের নির্দেশনা সরকারকে পালন করতে হবে- এটিই আইনগত সংগত। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ কিংবা এখতিয়ার নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা জনগণের জন্য কোনোভাবেই শুভপ্রদ নয়।
যদি যার যার কাজের সীমানা-ক্ষমতা কিংবা এখতিয়ারের ব্যাপারে সংশ্নিষ্টরা সজাগ থাকতেন, তাহলে বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টির অবকাশ থাকত না। একই সঙ্গে দরকার সবার সে রকম মানসিকতাও। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকারের প্রতিনিধি আর উপজেলা চেয়ারম্যান জনগণের প্রতিনিধি। উপজেলা পরিষদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ২০১১ সালে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হলেও এর কোনো সমাধানসূত্র মেলেনি। অনেক পরিপত্রই সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে এরই মধ্যে জারি হয়েছে। এখন আবার আমরা পেলাম এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে হাইকোর্টের নির্দেশনা। এমতাবস্থায় সরকার কীভাবে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পথ বের করবে, তা তাদেরই দায়িত্ব। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা-সংক্রান্ত বিধান পালনের যে নির্দেশনা উচ্চ আদালত দিয়েছেন, এর অবলম্বনে সরকারকেই সমাধান খুঁজতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বন্দ্বে দেশের বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই যে শুধু ব্যাহত হচ্ছে তা-ই নয়, জনগণও অনেক ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে পড়ছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান করোনা-দুর্যোগে সামাজিক ক্ষেত্রে নানা সমস্যা-সংকট দেখা দিয়েছে। বিপন্ন মানুষের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের ওপর জনগণের নির্ভরতা সংগতই আরও বেড়েছে।
আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামোর একেবারে নিম্নস্তর ইউনিয়ন পরিষদ, তারপর উপজেলা পরিষদ। আরও স্তর থাকলেও স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় এই দুই স্তরই বড় অংশ। আমরা আশা করতে পারি, যদি উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী বিদ্যমান বিরোধের সুরাহা হয়, তাহলে পৌরসভা ও জেলা পরিষদ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতা বা এখতিয়ারগত বিরোধের মীমাংসার পথ অনেকটাই খুলে যাবে। আমরা দেখেছি, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মধ্যে বিরোধও কম নয়। সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় সরকারের স্তরে নাক গলানো বা হস্তক্ষেপ করার উদগ্র বাসনা লালন করেন অনেকটাই রাজনীতির সমীকরণ কষে। একজন সংসদ সদস্যের মূল কাজ আইন প্রণয়ন। এটি তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে তারা হস্তক্ষেপ করার ফলে শুধু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদেরই ক্ষুব্ধ করে তোলে না, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও এর সুযোগ নিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যাবে। সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধির বিরোধের ফলে উন্নয়নকাজ অনেক ক্ষেত্রে আটকে আছে- এমন নজিরেরও অভাব নেই।
কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে জনপ্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এখতিয়ার কিংবা ভূমিকা নিয়ে ঝড় উঠেছিল। আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলেরই একজন সংসদ সদস্য এ ব্যাপারে তীব্র সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন। আর বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষের জের ধরে ন্যক্কারজনক ঘটনার ক্ষত সর্বসাম্প্রতিক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। বিষয়টি বরিশালেই থেমে থাকেনি; বিরোধের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক দূর। শেষ পর্যন্ত এর দৃশ্যত মীমাংসা হয়েছে বটে, কিন্তু ভেতরের ক্ষোভ কি প্রশমন হয়েছে? যে কোনো ব্যবস্থা যদি প্রশাসন কিংবা স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরে ক্ষোভ সৃষ্টির কারণ হয়, তাহলে ততক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষোভ প্রশমনের কোনোই উপায় নেই, যতক্ষণ না এর পরিবর্তন ঘটবে। অর্থাৎ অবস্থা ভালোর প্রত্যাশা করলে সর্বাগ্রে ব্যবস্থার বদল ঘটাতে হবে। এও খুব দূর অতীতের ঘটনা নয়, অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান বা বিরোধ তুঙ্গে ওঠার বিষয়টি। এ সবকিছুর অনেকাংশেই নিরসন সম্ভব, বিধিবিধান কিংবা আইন যা-ই বলি না কেন, এসবের যদি যথাযথ প্রতিপালন হয়।
জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরগুলো যাতে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে, এ জন্য এর সামনের সব প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা দূর করতে সরকারকেই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। সবকিছুই রাজনীতির ছকে ফেলে সমীকরণ করলে চলবে কী করে! একজন জনপ্রতিনিধি নিশ্চয় কোনোভাবেই ঢাল-তলোয়ারবিহীন ব্যক্তি হতে পারেন না। আইন কিংবা বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ যেখানে দরকার, সেখানে যদি উল্টো মারপ্যাঁচ তৈরির অবলম্বন খোঁজা হয়, তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। জনপ্রতিনিধিকে যেমন তার কাজের সীমানা কিংবা এখতিয়ার সম্পর্কে সজাগ থাকা উচিত, তেমনি জনপ্রশাসকদেরও তা মনে রেখেই দায়িত্ব পালনে নিষ্ট হওয়া জরুরি। দক্ষতা, সামর্থ্য, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহির মতো জরুরি বিষয়গুলোও আমলে রাখতে হবে। সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে কর্মপদ্ধতিও। এ সবকিছুর নিরিখেই নিজেদের প্রস্তুত করা কিংবা রাখা চাই।
জাতীয় সংসদের সদস্যরা যেমন জনপ্রতিনিধি, তেমনি উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, সিটি করপোরেশনের মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও সমভাবেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জাতীয় সংসদ সদস্যরা কিংবা জনপ্রশাসকরা তা ভুলে গেলে চলবে কী করে? এ ব্যাপারে অধিকতর সজাগ থাকা জরুরি সরকারকে। সরকারের কোনো নীতি বা উদ্দেশ্য কেন হবে বিভাজন সৃষ্টির কারণ?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
মন্তব্য করুন