- মতামত
- জীবনবারতা শেখ হাসিনা
জীবনবারতা শেখ হাসিনা

এমন এক সময়ে লেখাটার সূচনা, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় অভিভাষণ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে নিউইয়র্কে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন বিশ্বনেতাদের সঙ্গে। এবারের সফরটি বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পিতার প্রতি কন্যার আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে উত্তর লনে ইউএন গার্ডেনে তার নামে একটি বেঞ্চ স্থাপন করা। পরম মমতায় সেখানে তিনি একটি বৃক্ষও রোপণ করেন। এই জাতিসংঘেই ৪৭ বছর আগে জাতির পিতা বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
জাতির পিতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতিফলন শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতমভাবে লক্ষণীয়। আর তাই বিশ্বব্যাপী তার নেতৃত্বের স্বীকৃতিগুলো আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। জাতিসংঘের এবারের সফরও ব্যতিক্রম নয়। শেখ হাসিনা আরও একটি সম্মানে ভূষিত হলেন- জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এমডিএসএন) তাকে সম্মান জানাল 'এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার' প্রদান করে। শেখ হাসিনার বিভিন্ন অর্জনকে বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মধ্যে কয়েকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য; যা দক্ষিণ এশিয়া বা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর নেতাদের মধ্যেও অনুরণিত হয়। বিশ্ববাসী ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, তার সরকার ও জনগণের কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য অবলোকন করেছে।
সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। সেই সময়ে যখন শহরের নারীদের জন্যও সরাসরি নির্বাচন চিন্তার বাইরে ছিল, ১৯৯৭ সালে সেখানে তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো তৃণমূল পর্যায়ে নারীরা সরাসরি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এটিই ছিল অন্যতম মাইলফলক। নানা প্রতিকূলতা জয় করে ধীরে ধীরে নারীরা নিজেদের স্থান করে নিচ্ছেন সর্বত্র।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় পর্যায়ে তিন বছর পূর্তিতে সমকালে ২০১১ সালে আমার প্রবন্ধ 'ফিরে দেখা তিন বছর'-এ কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলাম, যে পদক্ষেপগুলো তখন না নেওয়া হলে আজ বাংলাদেশ এই কভিডকালে শতকরা ৪ ভাগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত না। সেই ফিরে দেখাতে শেখ হাসিনা গুরুত্ব দিয়েছিলেন দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোর ওপর। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়া, নারীর ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থানে পৌঁছা বা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা সূচকের অগ্রগতির বিষয়গুলো কোথাও থমকে দাঁড়ায়নি- বরং ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলোই রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে।
এক যুগ ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকে আছে সুবিশাল অর্জন। বাংলাদেশের নারীদের যে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রথম মেয়াদের তিন বছরেই নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন; নীতিনির্ধারণ; পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পেয়েছে নারী স্পিকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ। বিভিন্ন জেলায় সরকারি সংস্থায় নারীদের অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পেয়েছে নারী উপাচার্য, উপ-উপাচার্য পদগুলো। দৃশ্যমান এই অগ্রগতির মূলে বাংলাদেশের নারীদের যে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রথম মেয়াদের তিন বছরেই নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যেমন, নারী শিক্ষার্থীদের অবৈতনিক করে দিয়ে শিক্ষার প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি; মাতৃমৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রায় সরকারের নেওয়া নারীবান্ধব পদক্ষেপগুলো যেমন, ১৯৯৭ সালে একটি সফল নারী উন্নয়ন নীতিমালা তৈরি, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে 'পারিবারিক সহিংসতা নিরোধ আইন-২০১০', ৪৭টি মন্ত্রণালয়ের নারীবান্ধব বা জেন্ডার বাজেটিং ইত্যাদি। ২০২০ সালে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ অধ্যাদেশ জারি করা।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সূচকে বাংলাদেশ আজ তাই বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। এই অর্জনের বহু কারণের মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কভিড-১৯ বা মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ তিন সফল নারী নেতার তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নের সব সূচক পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। উত্তরোত্তর এই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি কারণ হচ্ছে জেন্ডার সমতা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশের নামও বাংলাদেশ (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০২০)। কভিড-১৯ মোকাবিলা করেও মুজিববর্ষে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে- এই আস্থার স্থানও তৈরি হয়েছে।
জলবায়ু কূটনীতিতে শেখ হাসিনার ধারাবাহিক অবদান আজ তাকে বিশেষ অবস্থানে আসীন করেছে। গত ৯ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল লিডার্স জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে বাংলাদেশে জন কেরির সফরটিও তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত। যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৫ সালে ভূষিত হয়েছেন 'চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ' পুরস্কারে। পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন 'ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম', 'ভালনারেবল টোয়েন্টি গ্রুপস অব ফাইন্যান্স মিনিস্টার'- ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম অনুষঙ্গ। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সবাই একই সুরে মন্তব্য করেছেন- জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে সবারই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আর এর মূলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্ব্যর্থহীন পদক্ষেপ ও উক্তি (কপ-২৫) : প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববাসীর কাছে এ বার্তা পৌঁছে গেছে যে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, কৃষি, বন, পানি, পশুসম্পদ রক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের উন্নয়নের সফল অগ্রযাত্রায় কভিড-১৯ ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল খ্যাত বাংলাদেশে কভিড-১৯ অতিমারির সময়েও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়ায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই এই সময়ে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২০ ভাগ হয়েছে। নারী দারিদ্র্য হ্রাসে চলমান সহায়তাগুলো থেমে থাকেনি। বরং কভিড-১৯ সময়ে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন দুস্থদের এবং দুর্যোগকবলিত এলাকার জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নারী নির্যাতন, দুর্নীতি ও মাদক রোধে 'জিরো টলারেন্স' নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ সহনশীল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে পারত। কিন্তু কভিড-১৯ মোকাবিলা করে এই উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করার জন্য বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সভায় আরও দু'বছর সময় বাড়তি হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। এখানেই প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার আরও একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে তিনি জানিয়েছেন, সরকার চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি কভিড-১৯ অতিমারির সময়ে জনগণের জীবিকা, খাদ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করা ও টিকাদান কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। গত ২ মার্চ জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের (এনইসি) আয়োজিত সভায় সভাপতিত্বকালে তিনি আরও জানান, কভিড-১৯-এর অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রচেষ্টার কারণেই দেশের অর্থনীতি সচল রয়েছে ও আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি।
শুভ জন্মদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রবাসী কবি মুরতাজা তারিনের (যা আপনাকে উৎসর্গ করে রচিত) পঙ্ক্তির উদ্ৃব্দতি দিয়ে বলি, 'আমি জীবনবারতা নিয়ে রঙ হয়ে ভাসি ...' আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
উপ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন