পৈতৃক নির্বাস পাবনার সাঁথিয়ায় হলেও মামার বাড়িতে (রাজশাহী) রণেশ মৈত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর। তিনি পদার্পণ করলেন ৮৯ বছরে। দীর্ঘ প্রায় ৯ দশক পাড়ি দিয়ে রণেশ মৈত্র বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ বটে, কিন্তু এখনও ক্লান্তিহীন একজন কর্মবীর। জীবনের বাঁকে বাঁকে তাকে নানা বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলেও গতি তার কখনও শ্নথ হয়নি। বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিমনা, বহুমাত্রিক লেখক রণেশ মৈত্র আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ লড়াকু যোদ্ধা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা ও গৃহিণী মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবেই বেড়ে উঠেছেন রণেশ মৈত্র ও তার ভাইবোন। মেজো ভাই বীরেশ মৈত্রের (পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান) প্রয়াণ ঘটে ২০০০ সালে। বাকি চার ভাইবোনের মধ্যে সবাই এখনও সচল।

সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু পেশাগত জীবন, ১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত 'নওবেলাল' পত্রিকার মাধ্যমে। এর পর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় কাজ করেন। এর পরের অধ্যায়ে তার সংযুক্তি ঘটে সংবাদ, ডেইলি মর্নিং নিউজ ও দৈনিক অবজারভারে। কাজ করেছেন নিউ নেশন ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায়ও। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৮ সালে অর্জন করেন একুশে পদক।

রণেশ মৈত্র ১৯৫০ সালে যুক্ত হন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। ১৯৫২ থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে। ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ার একজন সংগঠক হিসেবে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। ভাষাসংগ্রামী রণেশ মৈত্র ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও ১৯৫৭ সালে ঘটে রাজনৈতিক বাঁক পরিবর্তন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে 'ন্যাপ' গঠনে সক্রিয় হন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যৌবনটা কেটে যায় প্রায় কারাগারেই। ১৯৫৯ সালে ২৬ বছর বয়সে পূরবী তালুকদারের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলেও যুগল জীবনের সুখ তিনি খুব একটা ভোগ করতে পারেননি বারবার কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে।

তার জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনাবোধ- সবকিছুই নির্মিত সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সড়ক ধরে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ের নিরলস কর্মী, রাজনীতিক-সাংবাদিক রণেশ মৈত্র ক্লান্তিহীন ও নির্ভয়ে পথ চলেছেন, চলছেন। এখনও তিনি তার কর্ম-সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতায় একজন অনুসন্ধানী ব্রতী। নিয়মিত পত্রপত্রিকায় কলাম যেমন লিখছেন, তেমনি গ্রন্থ রচনায়ও সমভাবে মনোযোগী। ভাষা-সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্পকলাবিষয়ক বই ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি কালের সাক্ষী। এই গ্রন্থে উঠে এসেছে বাল্যকালে প্রত্যক্ষ করা দুর্যোগাক্রান্ত সময়ের চিত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্ব এবং স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন পর্বের ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি তার লড়াকু জীবনের ঘটনাবলি উপস্থাপিত হয়েছে এ গ্রন্থে যেন কালের উপাখ্যান হিসেবে। প্রগতিবাদী রণেশ মৈত্র এখনও সম্পৃক্ত রাজনীতির সঙ্গে। 'ঐক্য ন্যাপ'-এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রণেশদার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয় ফোনে। বুঝতে পারি, তিনি এখনও সেই রকমই তেজোদীপ্ত।

৮৯-তে পা দিয়েও বয়সের চাপে তিনি থেমে নেই। শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ধারণ করে আন্দোলন-সংগ্রামের সক্রিয় অংশীজন। অর্থাৎ তিনি রণে ভঙ্গ দেননি। স্বাধীন বাংলাদেশেও কারাবাসকারী এই সাংবাদিক-রাজনীতিক বলেন, 'মানুষের কতই না ভালোবাসায় সিক্ত আমি!' তার এই প্রাপ্তি কিংবা সুখই তাকে এখনও রেখেছে প্রাণবন্ত-উচ্ছ্বসিত ও কর্ম-উদ্দীপনায় ব্যাপ্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন অধ্যায়ের দিকেও তিনি করেছেন গভীর আলোকপাত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাবাসের সময় তিনি তার কাছে যাওয়া, খুব ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটানোর সুযোগ পান এবং রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা করেন। বর্ণিল চিত্রগাথা জীবনাধিকারী শ্রদ্ধাস্পদ রণেশ মৈত্রকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন রণেশদা। 'নব্বইয়ে তরুণ' রণেশদা আমাদের মাঝে থাকুন প্রাণবন্ত।

লেখক ও সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com