
করোনাকালে গত এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা আট হাজার ২২৮ ও পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ছয় হাজার ২০৮টি। নারীদের ক্ষেত্রে যা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ। কিন্তু কেন এই আত্মহনন? জানা যায়, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট- এসবই আত্মহত্যার মূল কারণ।
সম্প্রতি যে আত্মহত্যাটি ঘটতে গিয়ে ঘটেনি, সেটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ ছাত্রের প্রকাশ্যে চুল কেটে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। ঘটনাটির ব্যাপক প্রচার হয়। আর এই ১৪ জনের মধ্যে একজন ভুক্তভোগী গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার নাজমুল বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই তিনি অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বোঝাই যাচ্ছে, নাজমুল বেশ আবেগপ্রবণ; পাশাপাশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। আমরা যদি শিক্ষক হয়ে সন্তানের মতো ছাত্রকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিই, এ দায়ভার কার? সমাজের, নাকি সামাজিকতার! নাকি ব্যক্তিগত ক্ষোভ?
পাশাপাশি গত ১৫ সেপ্টেম্বর ৯ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন ইভানা। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে আইন বিভাগে পড়ে যখন তার বার স্কুলে আবেদন করার কথা, তখন থেকেই চুপচাপ ইভানা। কারণ ব্যারিস্টারি পড়তে যেতে দেওয়ায় আপত্তি তার পরিবারের। পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী ইভানা তাই ব্যারিস্টার না হয়ে হয়ে যান 'মিসেস ব্যারিস্টার'। স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কারণে নিজের দুই সন্তান নিয়ে ইভানা দিশেহারা। সম্ভাব্য তালাকের কথা ভাবতে গেলেই তার প্রথমে মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা। তারা কীভাবে বিষয়টি নেবেন? তাই তিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ।
কেন নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মেয়েকে প্রথম থেকেই শেখানো হয়, সে মেয়ে। তাকে মানিয়ে এবং মেনে সবাইকে খুশি করে চলতে হবে। এর পরের শিক্ষাটা এমন- সে নিরাপদ নয়। যে কোনো সময় তার জীবনে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তাই তাকে সেভাবে চলতে হবে, একা চলা চলবে না; অবশ্যই সূর্যাস্তের আগে ঘরে ফিরতে হবে। কিন্তু সেই সমাজ কখনও কোনো ছেলেকে শেখায় না- তোমরা অসামাজিক কাজ বা অনৈতিক আচরণ থেকে দূরে থাকো। তবেই একটি মেয়ে নিরাপদে পথ চলতে পারবে। বরং ছেলেদের বোঝানো হয়, এ সমাজে তোমরাই সমাজপতি। শুধু তাই নয়, পরিবারেও তোমাদের অধিকার বেশি। ফলে নারীরা কোথাও নিরাপদ বোধ করে না।
একটি মেয়ের বিয়ে হলেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়- শ্বশুরবাড়িই আজ থেকে তার নিজের বাড়ি। বাবার বাড়িতে তার আর আগের মতো অধিকার নেই। যদি সে তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়িতে সমস্যায় থাকে, তবুও তাকে সেখানে মানিয়ে নেওয়ার কথাই বলে তার বাবার পরিবার। যদি তার ভাইয়ের মতো বাবার বাড়ির প্রতি অধিকার থাকত সমানে সমান, তবে সে হয়তো ফিরে আসতে পারত নিজের ঘরে। কিন্তু সে তো জানে না তার নিজের ঘর কোনটি?
আবার একটি মেয়ের সময়মতো (সামাজিকভাবে বেঁধে দেওয়া সময়) বিয়ে না হলেও তাকে শুনতে হয় নানা কটু কথা। সমাজ-আত্মীয়-পরিজনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরাও তাকে কটু কথা বলতে পিছপা হয় না। ফলাফল নারীর আত্মহননের সংখ্যা বেশি।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর আত্মহত্যার হার ৩৫ শতাংশ। এই বয়সীদের আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে প্রথমেই সন্তানকে ভালোবাসতে হবে। উজাড় করা ভালোবাসা। যেন সে বাবা-মায়ের কাছে আশ্বস্ততার জায়গা খুঁজে পায়। সে যেন তার সব কথা নির্দি্বধায় বলতে পারে তাদের কাছে। পাশাপাশি বাবা-মায়েরও সন্তানকে ভালো-মন্দের তফাত বুঝিয়ে দিতে হবে।
২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী আত্মহত্যার প্রবণতা ৪৯ শতাংশ এবং ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী আত্মহত্যার প্রবণতা ১১ শতাংশ। এটি রোধ করতে ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। তার সীমা আকাশ অব্দি- এসব বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। খুব অল্পতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। একটি বিষয়ে সমস্যা হতেই পারে, তখন অন্য বিষয়ে চলে যেতে হবে। আত্মোপলব্ধি প্রবল করে তুলতে হবে। আর প্রত্যেকের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা বাড়াতে হবে। আত্মচর্চাও কাজে লাগাতে হবে।
৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের ৫ শতাংশ আত্মহনন করে। এরা অধিকাংশ একাকিত্বে ভোগে। সন্তানদের আত্মহত্যা রোধে যেমন বাবা-মায়ের দায়বদ্ধতা থাকে, তেমনি সন্তানদেরও দায়বদ্ধতা থাকে একটি বয়সে এসে নিজেদের শত ব্যস্ততা এড়িয়ে বৃদ্ধ বাবা-মাকে সময় দেওয়ার। তবেই সম্ভব আত্মহত্যা রোধ করা। ঝরে না যাক আর একটিও প্রাণ স্বেচ্ছায়। আসুন, আত্মহত্যার পরিবর্তে জীবনকে উদযাপন করি।
গবেষক, লেখক ও সংগঠক
মন্তব্য করুন