পানির দামে- এ শব্দ দুটি এখন আর প্রাণীর চামড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। সারাবছর যেসব প্রাণী মানুষের মাংসের জোগান দেয়, সেগুলোর চামড়ার দামের খোঁজ না জানলেও সাধারণ মানুষ কোরবানির সময়কার চামড়ার দামটা জানে। গত কয়েক বছর কোরবানির সময় প্রাণীর চামড়া আক্ষরিক অর্থেই মূল্যহীন হয়ে গেছে।

কোরবানির চামড়া দেশের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব রাখে, সেটা আমরা অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না। আমি চামড়া শিল্পের কথা বলছি না। কাঁচা চামড়া বিক্রির টাকার পুরোটা যায় সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের হাতে। এটা ওই মানুষদের কষ্ট যেমন লাঘব করে কিছুটা হলেও, তেমনি কয়েকশ কোটি টাকার সম্মিলিত ব্যয়ের একটা প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, করোনার এই সময়ে যখন এসব মানুষের কাছে এই টাকাটার মূল্য আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন করোনার মধ্যে পরপর দুটি ঈদে চামড়া একেবারে মূল্যহীন হয়ে গেছে। চামড়ার দরপতন শুরু হয়েছে সত্যি বলতে আরও কয়েক বছর আগে থেকে। সরকারের এক লজ্জাজনক ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে এই জায়গায় নিয়ে গেছে।

দীর্ঘকাল থেকে অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, শুধু একটা রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা ভঙ্গুরতার পরিচায়ক। বাংলাদেশকে অবশ্যই রপ্তানির ক্ষেত্রে তার পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। সে আলোচনায় চামড়াপণ্য বেশ কয়েক বছর থেকে আলোচনায় ছিল। আমরা অনেকেই হয়তো ভাবছিলাম, এ খাত ধাপে ধাপে দাঁড়িয়ে যাবে এবং সেটি গার্মেন্টের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও ধীরে ধীরে সেটি আমাদের রপ্তানির একটি বড় পণ্যে পরিণত হবে। সরকারের যে ব্যর্থতার কারণে গরিব মানুষ চামড়ার দাম পায়নি; ঠিক একই কারণে চামড়া সেই রপ্তানি পণ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

দেশের একটি নদী বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে মরে যাচ্ছিল। একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই দূষণকে কমিয়ে নদীটিকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আরেকটি সুস্থ নদী ধলেশ্বরীর।

এতক্ষণ যেসব পরিস্থিতির কথা বললাম, তার সবকিছু ঘটেছে যে পদক্ষেপের কারণে, সেটা হচ্ছে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারের বিশেষায়িত এলাকায় সঠিকভাবে স্থানান্তর করতে না পারা। সত্যিই একটা প্রকল্প বাস্তবায়নে লজ্জাজনক ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত গরিবের হক কোরবানির চামড়া মূল্যহীন হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট সাভারের ট্যানারিগুলো বন্ধ করতে বলেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সব ক্ষেত্রে নির্ধারিত মান নিশ্চিত করে সেগুলো আবার চালু করার কথা বলেছেন তারা।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বীভৎস রকম দূষণ করছিল বুড়িগঙ্গার। ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য অন্যান্য শিল্প বর্জ্যের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ, এখানে মানবদেহের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর অনেক ভারী ধাতুর কেমিক্যাল ব্যবহূত হয়। তাই কারখানাগুলোকে সরিয়ে একটা পরিকল্পিত এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আপাতদৃষ্টিতে ভালো ছিল। সে লক্ষ্যেই স্থাপন করা হয়েছিল সাভার ট্যানারি শিল্প এলাকা।

সেই শিল্প এলাকায় যখন ট্যানারিগুলো যেতে চাইছিল না, তখন পরিবেশবাদীরা তো বটেই, একজন নাগরিক হিসেবেও খুবই বিরক্ত বোধ করছিলাম। এর পর উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে রীতিমতো বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের মতো প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে কারখানাগুলোকে সাভারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাভারে সেই সুবিধার জন্য সবাই অপেক্ষা করে ছিলেন, যেটা ছিল না হাজারীবাগে এবং যেটার অনুপস্থিতি দূষিত করে মেরে ফেলে একটা নদীকে- একটা সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিএটিপি)। অর্থাৎ এখানে সব কারখানার বর্জ্য একটা কেন্দ্রীয় শোধনাগারে আসবে। সেখানে শোধন করার মাধ্যমে ভারী ধাতু এবং অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান আলাদা করে বাকিটা নদীতে ফেলা হবে।

একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও গার্মেন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকার নিজ থেকে ব্যবস্থা নেয়নি, বরং নিয়েছিল আমদানিকারকদের প্রচণ্ড চাপে। এখানেও ঠিক একই রকম পরিস্থিতি। ভেবেছিলাম, অন্তত সে কারণে হলেও এই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট খুব ভালোভাবে তৈরি হবে।

পরিবেশগত সবদিক ঠিক রেখে ট্যানারিগুলো চলতে পারলে তারা পেত বৈশ্বিক জোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) পরিবেশসম্মত কারখানার সনদ। এতেই তাদের পক্ষে রপ্তানিতে অনেক এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। কারণ, এই সনদ থাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডগুলোর আমদানির গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ কারণেই এখন রপ্তানি বাড়া দূরে থাক, রপ্তানি আগের জায়গায়ও থাকছে না; কমে যাচ্ছে।

গত অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির আয় পাঁচ বছর আগের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। ঠিক এ কারণেই রপ্তানিমুখী এ শিল্পটির অত্যাবশ্যক কাঁচামাল কাঁচা চামড়ার চাহিদা কমে গেছে অনেক। তাই চামড়ার দরপতন হচ্ছে। অবশ্য এটুকু বলে রাখা ভালো, এর মধ্যেও যদি ব্যবসায়ীদের কারসাজি না থাকত তাহলে দাম এতটা পড়ত না।

২০১২ সালে একটি চীনা কোম্পানিকে সিইটিপি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেটি দুই বছর পর পূর্ণ সক্ষমতাসহ হস্তান্তর করার কথা ছিল। মজার ব্যাপার, সেটি হস্তান্তর করা হয়েছে দীর্ঘ ৯ বছর পর; এ বছরের জুনে। এমনকি এখন পরিবেশ অধিদপ্তর পরীক্ষা করে বলছে, স্থাপনাটি মোটেও ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রক্রিয়াজাতকরণের পর যে পানি নদীতে ছাড়া হচ্ছে, পরিবেশ অধিদপ্তর পরীক্ষা করে দেখেছে- সেখানে এখনও ক্ষতিকর পদার্থ রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, সক্ষমতায় সিইটিপি তৈরি হয়েছে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে তার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। তাহলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কী হবে?

শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট