চট্টগ্রাম শহরের উন্মুক্ত খাল ও নালা দিন দিন যেভাবে মরণফাঁদ হয়ে উঠছে, তা সংগত কারণেই উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। রোববার সমকালে বাণিজ্যিক নগরীর 'পথে পথে মরণফাঁদ' শীর্ষক সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার শুধু চশমা খালেই গত তিন মাসে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। সেখানে অন্তত পাঁচটি খাল ও অর্ধশতাধিক নালা ঘুরে সমকাল প্রতিবেদক কোথাও নিরাপত্তা বেষ্টনী কিংবা কোনো সতর্কবার্তা দেখেননি। নালাগুলোও উন্মুক্ত। আমরা বিস্মিত, একের পর এক মৃত্যুর পরও খালের পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী কিংবা নালায় স্ল্যাব বসানো নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই! বরং রোববার সমকালেরই আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, নালা-নর্দমায় পড়ে একের পর এক হতাহতের ঘটনায় পরস্পরকে দুষছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-চসিক এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। সিটি মেয়র বলছেন, প্রকল্প পরিচালনায় সিডিএর ব্যর্থতার কারণে এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে।
অন্যদিকে সিডিএ চেয়ারম্যান বলছেন, নালা-নর্দমা পরিস্কার করা ও তার ওপর স্ল্যাব দেওয়া সিটি করপোরেশনের কাজ। এভাবে দোষারোপ করে দিন দিন সমস্যাটি জিইয়ে রাখলে মানুষের দুর্ভোগ ও হতাহতের ঘটনা- উভয়ই বাড়বে।
আমরা জানি, এমনিতেই চটগ্রাম নগর জলাবদ্ধতার সমস্যায় জর্জরিত। সেখানে একটু বৃষ্টি হলেই যেমন
জলাবদ্ধতা লেগে যায়, তেমনি সড়ক-নালা একাকার হয়ে পড়লে মানুষের মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পেও দেখা গেছে ত্রুটি। সম্প্রতি সমকালের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, চট্টগ্রামের দুঃখ জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রকল্পেই নানা ত্রুটি দেখা দিয়েছে। সেখানেও এটা স্পষ্ট, মহানগরীর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যেমন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহরে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
শুধু সাদিয়াই নন, সাম্প্রতিক সময়ে এসব খাল-নালায় পড়ে অন্তত চারজন মারা গেছেন। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রামে ৫৭টি খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৬৫ কিলোমিটার। আর নালা রয়েছে ৯৭২ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে এর অর্ধেক অংশেই স্ল্যাব বা নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। সেখানে খেলাধুলা করতে করতে শিশুদের পড়ার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকও একটু অসতর্ক হলেই পড়ে যাচ্ছেন। এরপরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না কেন? সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে খালে এক ব্যবসায়ী পা পিছলে পড়ে যান। এর পর এক মাস পার হলেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। ওই ঘটনার পর নগরের উন্মুক্ত খাল-নালা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের মেয়র। কিন্তু প্রতিশ্রুতির এক মাসেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর মধ্যেই গত সপ্তাহে পা পিছলে নালায় পড়ে মারা গেলেন সাদিয়া।
চট্টগ্রামে যেভাবে মানুষ মারার ফাঁদ তৈরি হয়ে আছে, তার দায় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আমরা চাই, অবিলম্বে চট্টগ্রামে খাল ও নালা চিহ্নিত করে এর পুরো অংশে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও স্ল্যাব বসানো হোক। এ ক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্বাভাবিকভাবেই নগর পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দুটি সংস্থার পরস্পরবিরোধী অবস্থান সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের গতিকে ব্যাহত করবে।
আমাদের প্রশ্ন, নগরীর যেসব ফুটপাত ও নালায় জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ হচ্ছে, সেগুলোর চারপাশে কেন নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি? স্ল্যাব উঠিয়ে সিডিএ নালার কাজ করলেও কাজ শেষে আর সেটি যথাস্থানে প্রতিস্থাপন না করায় দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সেখানে যথাযথ সমীক্ষা না করার কারণেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আমরা প্রত্যাশা করি, চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে 'যা খুশি' করার মনোভাব দূর করতে হবে। যে কোনো ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নগরবাসীর কষ্টের বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি। চট্টগ্রামের জনদুর্ভোগ যেভাবে চরমে উঠেছে, সরকারকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতেই হবে।
মন্তব্য করুন