আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এক অনন্য কর্ণধার। রাজনীতিতে যেমন ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প স্থাপনেও তিনি ছিলেন একজন ঈর্ষণীয় সফল ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) অর্জন করেছেন।
১৯৪৫ সালে হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতা নুরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন একজন আইনজীবী এবং জমিদার। তিনি ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। একই বছরে ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো তার পাথরঘাটার জুপিটার হাউস থেকে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান, সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভুমিকা রাখেন। পরে ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানাম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের যার সুযোগ হয়েছে, সে-ই সৌভাগ্যবান। বিশ্বস্ততার সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্তত আমরা যারা তার অভিভাবকত্বে তার সঙ্গে রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, তাকে কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি। সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমরা দেখেছি, তার মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালোবাসার উদার মনমানসিকতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের সম্মুখসৈনিক ছিলেন। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।