
সহজাত প্রায়োগিক গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে নূ্যনতম মজুরি হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত কর্মসংস্থান পরিস্থিতির কার্যকারণ প্রভাবকে অর্থনীতির প্রচলিত তত্ত্বের বাইরে ব্যাখ্যার কারণে ২০২১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিন আমেরিকান অর্থনীতিবিদ- ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার (বার্কলি) ডেভিড কার্ড, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) যোশোয়া ডি. অ্যাংগ্রিস্ট এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গুইডো ইবেন্স।
শ্রম অর্থনীতি এবং বিবিধ গবেষণায় সহজাত পরীক্ষণ পদ্ধতির প্রায়োগিক ব্যবহার সফলতার সঙ্গে প্রচলনে এবারের নোবেল বিজয়ী তিনজনেরই রয়েছে কমবেশি ৩০ বছরের নিরলস শ্রম। অর্থনীতির জগতে এই তিনজনকে বলা হয় ইকোনমেট্রিক্স টুল ডেভেলপার। তাত্ত্বিক বিষয়াদির যৌক্তিকতা প্রকাশিত হয় সংশ্নিষ্ট গবেষণার ফলাফল হতে। গবেষণালব্ধ ফলাফল যেমন একাধারে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করে, তেমনি বিপরীতধর্মী ফলাফল প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীনও করতে পারে। বিরাজমান গবেষণা পদ্ধতির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তথ্য-উপাত্তের প্রায়োগিক ব্যবহার ও প্রাপ্ত ফলাফলের যৌক্তিকতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পদ্ধতির মতো সমাজবিজ্ঞানেও ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্ট (সহজাত পরীক্ষামূলক) পদ্ধতির প্রচলনে কার্ড, অ্যাংগ্রিস্ট ও ইবেন্সের অবদান অনস্বীকার্য।
ডেভিড কার্ডকে মনোনীত করা হয়েছে শ্রম অর্থনীতির দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে প্রাপ্ত ভিন্নধর্মী ফলাফলকে সহজাত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কার্ড এটা প্রমাণ করেন যে, অর্থনীতির চাহিদা তত্ত্বের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো দ্রব্য বা সেবার বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পেলে সেটির চাহিদা কমবে- এ ব্যাপারটি সবসময় সত্যি নয়। এক্ষেত্রে তিনি উল্লেখ করেন শ্রমবাজারে নূ্যনতম মজুরি সীমাকে যদি বিরাজমান মজুরির চেয়ে কোনোভাবে বৃদ্ধি করা যায় তবে তা প্রচলিত তত্ত্বের অনুগামী হয়ে কর্মসংস্থান কমিয়ে দেবে সেটি সঠিক নয়। তিনি এটি বলেন, শ্রমিকের নূ্যনতম মজুরি বৃদ্ধির ফলে একটি এলাকার কর্মসংস্থানে তা কোনোরূপ প্রভাব নাও ফেলতে পারে। স্বভাবতই তিনি তার দাবির পক্ষে সহজাত প্রায়োগিক গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেন, যেখানে আমেরিকার নিউ জার্সির রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি বৃদ্ধির ফলে নিউ জার্সি ও এর নিকটবর্তী পূর্ব পেনসিলভানিয়ান শহরের রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ডাটার পরিবর্তনে একটি ভিন্ন ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়।
ডেভিড কার্ড ও তার সহকর্মী অ্যালেন ক্রুয়েগার বহুদিন ধরে বিবিধ তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের ওপর শ্রমমূল্যের প্রভাব নিয়ে কাজ করে আসছেন। ক্রুয়েগার ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ না করলে হয়তো এবারের নোবেলের তিনিও আরেক অংশীদার হতেন। তাদের গবেষণা কাজের ফলাফলের কারণেই নূ্যনতম মজুরি বা শ্রমমূল্য বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানে এর প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতির অভিজাত অংশের ধারণার এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ১৯৯২ সালের তথ্য অনুযায়ী যেখানে আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের ৭৯ শতাংশ অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সদস্য মনে করতেন নূ্যনতম মজুরি বৃদ্ধি কর্মসংস্থান হ্রাস করবে, সেখানে ২০০০ সালে এরূপ ধারণা পোষণ করা ওই সদস্যের সংখ্যা কমে গিয়ে হয় ৪৬ শতাংশ। কার্ড ও ক্রুয়েগারের গবেষণার ফলাফল এ বিষয়ে আরও অধিকতর গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় এবং পরবর্তীকালে ইবেন্স ও অ্যাংগ্রিস্টের প্রায়োগিক গবেষণায় সহজাত পরীক্ষা পরিচালনা করার বিষয়টি অত্যন্ত উপকারী ও প্রয়োজনীয় বলে গবেষকদের কাছে সমাদৃত হয়। কার্ডের বক্তব্যের সমর্থনে গবেষকরা মতপ্রকাশ করেন যে, নূ্যনতম মজুরি বৃদ্ধিজনিত উৎপাদন খরচটি হয়তো স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদক কর্তৃক উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সমন্বিত করা যাবে, আবার কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় যদি ওই কারখানাটি একমাত্র শ্রমিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হয় তবে সেই কারখানা স্বাভাবিকের চেয়ে কম নূ্যনতম মজুরি প্রচলিত রেখে পরবর্তী সময়ে মজুরি বৃদ্ধি করলেও কারখানাটি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান অপরিবর্তিত রাখতে পারবে।
গবেষণা পদ্ধতির ক্ষেত্রে সহজাত পরীক্ষার প্রায়োগিক ব্যবহারের বিষয়ে অবদান রাখার জন্য অ্যাংগ্রিস্ট ও ইবেন্সকে যৌথভাবে নোবেলে ভূষিত করা হয়। মূলত অর্থনীতির গবেষণার ক্ষেত্রে যখন প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় না বা তা হতে প্রাপ্ত উপসংহারে সর্বজনস্বীকৃত উপায়ে উপনীত হওয়া যায় না তখন এর পরিবর্তে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহুল ব্যবহূত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্ট বা সহজাত পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যবহার সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের বিষয়াদিতে প্রচলন করার কৃতিত্ব দেওয়া হয় অ্যাংগ্রিস্ট ও ইবেন্সকে। এ ক্ষেত্রে গবেষকরা যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করতেন তা ছিল কোনো একটি বিষয় ঘটার বা পরিবর্তনের কারণ ও ফলাফলের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের প্রবহমান ধারা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে। অনেক চলকের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকলেই যে একটির কারণে আরেকটি ঘটবে বা পরিবর্তিত হবে তা অর্থনীতিতে সাধারণভাবে গ্রহণ করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে কার্ডের গবেষণা যেমন উল্লেখ করেছে যে শুধু আরও একটি বছর অধিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলেই একজন ব্যক্তি বা শ্রেণি অন্য আরেকটি নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি বা শ্রেণি, যাদের এক বছর শিক্ষা কম আছে তাদের চেয়ে বেশি আয় করবে তা নয়, কেননা বেশি আয় করা শ্রেণিটির অন্যান্য আরও অনেক বিষয়ও তার এই বেশি আয়ের ব্যাপারে প্রভাব ফেলতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে অর্থনীতিতে এই এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণা পদ্ধতির ব্যবহার অর্থনীতির গবেষণাগুলোকে সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কার্ড, ক্রুয়েগার, অ্যাংগ্রিস্ট ও ইবেন্সের এসব সমন্বিত কাজ একাধারে যেমন গবেষণার ফলাফলকে তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙি থেকে অধিকতর প্রায়োগিক বাস্তবধর্মী করেছে, তেমনি উন্নয়ন অর্থনীতি, শ্রম অর্থনীতি, কল্যাণ অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতিসহ সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের অন্য সকল শাখাতেও গবেষকদের অনুসরণ করার মতো সহজাত পরীক্ষণ পদ্ধতিটির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্পন্ন করেছে। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অর্থনীতিতে ব্যবহূত এই ন্যাচারাল এক্সপেরিমেন্টাল পদ্ধতিরও অবস্থানভেদে সীমাবদ্ধতা বিরাজমান রয়েছে।
যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিলেট
shimul.ecomind@gmail.com
মন্তব্য করুন