আসন্ন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সংঘাত-সহিংসতা থামছেই না। আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার পাশাপাশি দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের তালিকাও। এই পরিস্থিতি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। বুধবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন 'বিব্রত ও উদ্বিগ্ন'। মঙ্গলবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনে সিইসি ও তিনজন নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্নিষ্টদের বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার। তারা সক্রিয় হলে সহিংসতা কমবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আমরা জানি, নির্বাচন পরিচালনাসহ নির্বাচনকালীন সব কর্মকাণ্ডেরই মূল নিয়ামক শক্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সুষ্ঠু, অবাধ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাদের যে এখতিয়ার রয়েছে, এর যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করা গেলে বৈরিতার পথ রুদ্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার খতিয়ান বিস্তৃত করে চলেছে। সরকার ও প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের চাহিদার নিরিখে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে সহায়তা করতে বাধ্য। নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই একদিকে অদক্ষতার পরিচয় যেমন দিয়ে চলেছে, অন্যদিকে তাদের কর্মকাণ্ড একের পর এক নেতিবাচক প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে। মঙ্গলবার সমকালেই বলা হয়েছে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার কারণে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে বসছে নির্বাচন কমিশন।

আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, এর আগে অনুষ্ঠিত ৩৬৪টি ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতায় হতাহতের পরও কেন নির্বাচন কমিশনের ঘুম ভাঙতে বিলম্ব হলো? আমরা দেখছি, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরুর পর থেকেই সংঘাত-সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বুধবারই সমকালের ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম হুংকার দিয়েছেন 'নৌকায় ভোট না দিলে কবর দিতে দেওয়া হবে না'। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাবান প্রার্থীরা ভোটারদের লক্ষ্য করে হুমকি-ধমকির খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসছে। এমনটি স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেই শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও কলুষিত করছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক নানামুখী সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে গ্রামীণ ভোট পর্বও এর ঐতিহ্যবাহী মেজাজ ধরে রাখতে পারেনি।

আমরা জানি, নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাই এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কানে তুলা দেওয়া কিংবা পিঠে কুলো বাঁধার অবকাশ নেই। কেবল সংঘাত-সহিংসতাই নয়; নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রায় সব ক্ষেত্রেই অস্বচ্ছতার অভিযোগের বৃত্তও ভেদ করে আসতে পারছে না নির্বাচন কমিশন! আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে অব্যবস্থা-অপূর্ণতার সাক্ষ্য থেকেই যাচ্ছে। এ ছাড়া জনগণের রায় ছাড়াই প্রার্থী নির্বাচিত হচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনটিও জনগণের ভোটাধিকার খর্বের শামিল। আমরা জানি, নির্বাচন কমিশন ঘিরে নাগরিক অসন্তোষ প্রবল। স্থানীয় সরকার কাঠামোর চলমান 'নিরুত্তাপ' নির্বাচনেও রক্তপাত ও ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা সেই অভিযোগগুলোকেই আরও শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা যথাযথভাবে ব্যবহার করে কেন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারছে না? নির্বাচন কমিশন অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে কি? স্বীকার করি, এ ক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোরও দায় আছে কিন্তু কার্যত মুখ্য ভূমিকা পালনের দায় নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশনের ওপর থেকে নেমে যাওয়া আস্থার পারদ পুনরুদ্ধারের দায়ও তাদেরই। 

বিষয় : সম্পাদকীয় ইউপি নির্বাচন

মন্তব্য করুন