'প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী/এমন দুর্দিনে তাই তো মনে পড়ে/তোমার হাসি মুখ, তোমার বরাভয়/ভীরুতা চারদিকে, তুমিও নেই পাশে।' বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর একুশের প্রথম কবিতা রচয়িতা রূপে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার লেখা কবিতা 'কাঁদতে আসিনি- ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালীন সরকার সে কবিতা নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং বাজেয়াপ্ত করেছিল। কিন্তু তার আগেই রোগশয্যায় লেখা কবির এই শানিত কবিতা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের বিশাল জনসভায় আবৃত্তি করে শোনানো হয়েছিল। সময়টি ছিল ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। এই কবিতা সেদিন জনগণকে করেছিল ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত। লিফলেট আকারে ছাপানো এই দীর্ঘ কবিতা গোপনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সারাদেশে। মানুষ হয়েছিল উত্তেজিত। এতে কবি হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এই কবিতা লেখার জন্য জেলও খেটেছেন অসাম্প্রদায়িক এই কবি। আজকে যখন ৫০ বছরে পা দেওয়া বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা ঘটছে, তখন তাকে খুব মনে পড়ছে।

বহুমাত্রিক মানুষ মাহবুব উল আলম চৌধুরী ৯৪ বছর আগে ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আহমদুর রহমান চৌধুরী। মাতার নাম রওশন আরা বেগম। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। অশেষ আদরে বড় হওয়া সত্ত্বেও আজীবন তিনি তার কিশোরী মাকে খুঁজে ফিরেছেন। গহিরা হাই স্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থি রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত করেছিলেন। ফলে চট্টগ্রামে কলেজে পড়ার সময়ে রাজনৈতিক কারণে কলেজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৪২ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশবিরোধী 'ভারত ছাড়' আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। একই সময়ে তিনি চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে দাঙ্গাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি 'সীমান্ত' নামে একটি প্রগতিশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৯৪৭-১৯৫২)। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করার জন্য চট্টগ্রামে যে কর্মী বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার আহ্বায়ক। ১৯৫৫ সালে তাকে চট্টগ্রাম শাখা যুবলীগের সভাপতি করা হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নানাভাবে তিনি নিজেকে এই যুদ্ধে জড়িত করেছিলেন।

চিত্তের বৈভবে ঐশ্বর্যশালী অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ অত্যন্ত মর্মাহত করে। মনুষ্যত্বই মানুষের প্রথম পরিচয়- এই বিশ্বাসে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। নইলে অগণিত মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হতো না। নানামুখী কাজও করতে পারতেন না। তবে মানুষের মধ্যে সুস্থ, মানবিক, সাংস্কৃতিক বোধ জাগ্রত করতে তিনি আমৃত্যু তার লেখনী সচল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন।

তার লেখা আত্মজীবনী 'স্মৃতির সন্ধানে' গ্রন্থে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, 'চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুরা যেন ওপারে না যায়, তার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমি কাজে লেগে গেলাম। ভারত থেকে আসা মোহাজেরদের জন্য কাজ শুরু করলাম। কলকাতায় গিয়ে ওপার বাংলায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নেতা কমরেড অম্বিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে অনেক উদ্বাস্তু শিবির দেখতে গেলাম।'

মাহবুব উল আলম চৌধুরী অনেক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন নিজ কর্মগুণে। উদারহৃদয় মানুষটির ৯৫তম জন্মদিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

নারীনেত্রী