
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর যে সিপাহি ও জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল; দেশবাসী ও সামরিক বাহিনীর সব সিপাহির যে দেশপ্রেমের মৈত্রী বন্ধনের সংহতির অভ্যুত্থান ঘটেছিল; তার পেছনে এক দীর্ঘ জন-আন্দোলন প্রক্রিয়া কাজ করেছিল। সেটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। তার পেছনে যৌক্তিক কার্যকারণের পারস্পরিকতা ছিল। উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নানা রকমের স্বার্থের সম্পৃক্ততা ছিল।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দেখা গেল, বাকশাল সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রেসিডেন্ট পদে বসেছেন। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) নেতা প্রায় সবাই মন্ত্রিপরিষদে জায়গা পেয়ে সরকার পরিচালনা করছেন। ক্ষমতার এই পট-পরিবর্তনের সময়ে প্রথমে সামরিক আইন জারি করে সামরিক শাসন প্রচলন করা হয়নি এবং জাতীয় সংসদকেও অকার্যকর বা বিলুপ্ত করেননি তারা।
অবশ্য কিছুদিন পরেই সামরিক শাসন চালু করা হয় এবং জাতীয় সংসদ বিলোপ আর সংবিধান স্থগিত করা হয়। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয় মেজর বঙ্গভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেই পরিস্থিতিতে ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল তার ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে রাজি করান ছয় মেজরকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনে চেইন অব কমান্ডের অধীনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে। এর আগে মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে তার জায়গায় সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব স্টাফ করা হয়েছিল।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তখন সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস)। কর্নেল শাফায়াত জামিলের উদ্যোগে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গৃহবন্দি করে একটি অভ্যুত্থান ঘটান, তবে সেটি ছিল নিতান্তই রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান। খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ। বলা চলে, খন্দকার মোশতাক আহমদকে বাধ্য করা হয়। একই সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আহমদকে পদত্যাগ করিয়ে প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হয়। সেটা ৩ নভেম্বরের (১৯৭৫) ঘটনা।
ওই রাতেই বিদ্রোহী ছয় মেজরের বাহিনী (কিলিং স্কোয়াড) প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সহযোগিতায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সেলে জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও আবু হেনা কামারুজ্জামানকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। তার পরই ভোরে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে বিদ্রোহী এসব সেনা অফিসারকে সপরিবারে দেশত্যাগ করে থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এরই মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে ও জাসদ নেতাদের পরিচালনায় সব ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা নগরীসহ বিভিন্ন এলাকায় মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। তারা স্লোগান তোলে- 'সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই/ অফিসারদের রক্ত চাই।' এসব স্লোগান দিয়ে তারা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে সিপাহিদের সংগঠিত করতে থাকে। তারা ১৪ দফা দাবিনামার একটি লিফলেট ছড়িয়ে দেয় দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। ৬ নভেম্বর রাতে তারা তাদের আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। তবে এরই মধ্যে জিয়াউর রহমান সমর্থক সামরিক অফিসারদের বেশকিছু সদস্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পান। তাদের নেতৃত্বে ৬ নভেম্বর ভোরে সিপাহিদের একটি বড় দল ক্যান্টনমেন্টে সেনাপ্রধানের বাসভবনে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্ত করে এবং সেনাপ্রধানের পদে পুনঃদায়িত্ব গ্রহণের ব্যবস্থা করে।
ইতোমধ্যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের সামরিক অভ্যুত্থানের পতন ঘটে। তবে তখনও প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে যথারীতি দায়িত্ব পালনরত প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল এটিএম হায়দার ও আরেকজন সহযোগী অফিসারসহ কয়েকজন নতুন সংসদ ভবন এলাকার একটি ভবনে জাসদ গণবাহিনীর দু-তিনজন সামরিক অফিসার-নেতার হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। জেনারেল জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত হয়েছিলেন। কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে জাসদ-গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অপতৎপরতায় এই নিষ্ঠুরতা ঘটে।
এসব হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কোনো বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হতে পারে না। জিয়াউর রহমান পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দায়ী সবার বিচার করে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সেই সময়ে জাসদ ও তার দুই সংগঠনের বিপ্লবের নামে সৃষ্ট দেশব্যাপী নৈরাজ্য বিশেষভাবে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। সেনা অফিসারদের মধ্যে বিশেষভাবে জুনিয়র অফিসার লেফটেন্যান্ট, ক্যাপ্টেন ও মেজরদের মধ্যে দারুণ ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। 'চেইন অব কমান্ড' নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমানকে পরবর্তী দুই বছর সেসব সামাল দিতে যথেষ্ট সময় ও বাড়তি এনার্জি দিতে হয়েছিল।
জিয়াউর রহমান অত্যন্ত ধৈর্য, তীক্ষষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও সাহসী ভূমিকা দিয়ে সবকিছু যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তা ছিল নজিরবিহীন। বিদেশি ঝানু কূটনীতিকরা ও অনেক রাষ্ট্রনায়ক মন্তব্য করেছিলেন- জিয়াউর রহমান ওই সময়কালে বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় শক্তিশালী দায়িত্ব গ্রহণ না করলে বাংলাদেশ আফগানিস্তান বা বিশ্বের অন্য সব ব্যর্থ রাষ্ট্রের পর্যায়ে বিশৃঙ্খলায় ডুবে ধ্বংসের দিকে চলে যেত।
জিয়াউর রহমান ভাগ্যক্রমে নভেম্বরের (১৯৭৫) প্রথম সপ্তাহে ষড়যন্ত্রমূলক নৈরাজ্যের মধ্যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন সিপাহি ও অফিসারদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে। জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে অন্তত সাড়ে পাঁচ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আন্তর্জাতিক বলয়ে নিজের যথার্থ অবদান রাখতে পেরেছিলেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন