বাংলাদেশি সমাজের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথা আমরা বারবার জোর গলায় বলে আসছি। কিন্তু একের পর এক ঘটনা এর বিপরীত সত্যটাই প্রমাণ করে চলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে দেশের রাজনৈতিক চরিত্রকে। হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। বছর কয় আগে নাসিরনগরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষত না শুকাতেই এ বছর অক্টোবরে শারদীয় দুর্গাপূজার সময় সংঘটিত হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। হিন্দু সমাজে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেল হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভ ও অনাস্থা- শুধু নেতৃস্থানীয় রানা দাশগুপ্তই নন; দেখা গেল উত্তরাঞ্চলসহ গোটা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে। ঘটনা ১৩ থেকে ১৯ অক্টোবরের পরও থেমে থেমে ধর্মের নামে হিংসা-উন্মত্ত এক দল মানুষ ও নেপথ্যে সমাজের কিছু ক্ষমতাবানের উস্কানিতে মানবিক চেনতার মৃত্যু ঘটানো এক প্রেতনৃত্য।

সংবাদমাধ্যমে বিশেষ করে সংবাদপত্রগুলোতে ব্যাপকভাবে উল্লিখিত হয়েছে কয়েকটি অভিযোগ বিভিন্ন উৎসে। প্রথমত, অতীতের ঘটনাগুলোর বিচারহীনতা; দ্বিতীয়ত, ঘটনার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রমূলক রূপ। যে কারণে অতিদ্রুত সহিংসতা তথা হামলা ছড়িয়ে পড়েছে কুমিল্লার নানুয়াদীঘির পাড় থেকে উত্তরে রংপুরসহ সন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকায়। বাদ যায়নি পুবের শ্রীহট্টের বিভিন্ন জেলা যেমন- হবিগঞ্জ। এক কথায়, আক্রান্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং আক্রান্ত মানুষের মতে, পরিকল্পিত এ হামলা বন্ধে সংশ্নিষ্ট প্রশাসন ব্যর্থ। এমন কথাও তাদের ক্ষুব্ধ অভিমানে ব্যক্ত- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো এলে ক্ষতি অনেক কম হতো। একাধিক গ্রাম আগুনের হাত থেকে বাঁচত। তাদের যুক্তিসংগত ক্ষোভ :'চেনামুখগুলি আগুন ধরি দিল।'

সত্যি, দুঃখ বাঁধভাঙা হবে না কেন? দ্বিতীয়ত, এ কারণে যে, প্রধানমন্ত্রীর পূজার নিরাপত্তা সম্পর্কে আশ্বাস এবং দুর্বৃত্তদের প্রতি হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সহিংসতার ঘটনা ঠিকই ঘটে গেল। গোয়েন্দা সূত্র আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারেনি কেন, যে কাজ সাধারণত তারা ঠিকঠাক করে থাকে। এবার গোয়েন্দা ব্যর্থতার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীরও সঠিক সময়ে উপস্থিতিতে ব্যর্থতা। তাই ঘটনা ব্যাপক। আমার এক স্নেহভাজন সিনিয়র সাংবাদিকের ক্ষুব্ধ হতাশা। তার বাড়িতে এই প্রথমবার হামলা- এমন ব্যাপক সহিংসতা নাকি বহু বছর পর ঘটল। সুলতানা কামালের মতো ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলতে হয়, আমরা দুঃখিত; লজ্জিত। কারণ আমাদের সেক্যুলারিজমের মূলে আঘাত এই সহিংসতার ব্যাপকতা। ওই অনুজপ্রতিম সাংবাদিকের ক্ষোভে-দুঃখে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আঘাতটা বড় বেশি হৃদয়ে লেগেছে। অবশ্য তার নিরাপত্তায় নাকি স্থানীয় সব রাজনৈতিক দল সহৃদয় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবু হামলাকারীরা নিবৃত্ত হয়নি। আর ওর পরিবারের সবার দিনের পর দিন গোটা রাত আতঙ্কে জেগে থাকা। এটা কি আমাদের উপমহাদেশে সব সংখ্যালঘুর পাওনা- হোক তারা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান বা মুসলমান।

কিন্তু ব্যাপক হামলার মুখে এক চিলতে সহায়তার স্বস্তি, শান্তি, নিরাপত্তা কোনোটাই মেলে না। শুধু কি হবিগঞ্জ? রংপুরের পীরগঞ্জে সংঘটিত হামলার মুখে পরিস্থিতির সংবাদচিত্র পত্রিকায় পড়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। সারারাত নারী-শিশু-বৃদ্ধ অসহায় মানুষ ধানক্ষেতে মুখ লুকিয়ে ছিল। আতঙ্কে সময় কাটিয়েছে। বড় কথা- কেন চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে গেল? হয়ে গেল রূঢ়, ভয়ংকর! এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। সব লেখক, সাংবাদিক, সমালোচকের মুখে একই কথা- পূর্ব ঘটনার সঠিক বিচার ও শাস্তি না হওয়াতে এত বড় ঘটনা ঘটতে পারল। তাও স্থানীয়ভাবে নয়। একের ঘটনায় প্রায় সর্বত্র হামলা। বোঝাই যায়, ঘটনা উদ্দেশ্যমূলক, ব্যক্তিস্বার্থ। সমাজের প্রভাবশালী কারও কারও স্বার্থের কারণে সমাজের দুর্বল অংশে আঘাত এবং পরে ঠিকই দেখা যায়- বাস্তুভিটা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা জমিজমা জবরদখলই মূল উদ্দেশ্য।

দুই. এ পর্যন্ত যা বলেছি, তার একটি শব্দও মনগড়া নয়। বরং তা উপদ্রুত ও আক্রান্ত মানুষ এবং সংবাদপত্রের ভাষ্যনির্ভর। পত্রিকা থেকে বিশদ বিবরণ না তুলে আপাতত সংবাদ শিরোনাম ও সংশ্নিষ্ট দু-এক লাইন উদ্ৃব্দত করছি। তাতেই ঘটনার ভেতর-বাহির স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বোঝা যাবে কোথায় গলদ, কোথায় ঘাটতি, দায় কার বা কাদের। কারা এই অমানবিক ঘটনার জন্য শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। একটি কথা প্রথম থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে। আর তা হলো- কে এই কথিত ভবঘুরে ইকবাল, যার শয়তানির জন্য দেশজুড়ে ভয়ংকর, সহিংস ঘটনা ঘটতে পারল? কে তাকে কাজে লাগাল? সেই নেপথ্যের শক্তি ধরা পড়ছে না কেন? তাকে এবং উস্কানিদাতাদের ধরলে ঘটনার পুরো চালচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্রাসঙ্গিক একই শিরোনাম একটি দৈনিকে (৩০.০৯.২০২১) 'হামলা ঠেকাতে জোরাল পদক্ষেপ নেয়নি সরকার'। এ অভিযোগ অভিমানী সম্মিলিত সনাতন পরিষদের। 'অভিমানী' বলছি এ কারণে, তারা সর্বদা নির্বাচনে দল বেঁধে নির্দিষ্ট বাক্সে ভোট দিয়ে থাকে। আর তাদের শাসনামলে কিনা এই হামলা এবং তা আগাম ঠেকাতে না পারা! প্রায় একই রকম খবরের শিরোনাম অন্য একটি দৈনিকে একই তারিখে, 'বোরহানউদ্দিনে হামলাকারীদের চেনে না কেউ, গা-ছাড়া প্রশাসন'। প্রশাসন যদি গা-ছাড়া অর্থাৎ উদাসীন হয়, তাহলে কি আক্রান্ত কখনও সুবিচার পায়? নাকি সমাজে গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হয়? মনে হয়, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে অদ্ভুত এক সমস্যায় ভুগছে প্রশাসনের সংশ্নিষ্ট শাখাগুলো। সেই সুযোগ নিচ্ছে সমাজের দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদী দুর্বৃত্তরা।

এবারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যমের বহুমাত্রিক মূল্যায়নে একটি অভিযোগ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে এই মর্মে- পাঁচ বছর আগে সংঘটিত নাসিরনগরে হামলার সঠিক তদন্ত এবং সুবিচার হলে এবার হয়তো দুর্বৃত্ত দল এমন ব্যাপক হামলার ষড়যন্ত্র ও ছক তৈরি করার সাহস পেত না। কিংবা পেলেও নিরাপত্তা রক্ষায় শুরুতেই তৎপর হলে ইকবাল হোসেনকে চাপের মুখে রেখে কে তাকে নিযুক্ত করেছে- এ তথ্য জানার চেষ্টা করলেই হয়তো ঘটনার দীর্ঘ বিস্তার ঘটত না। এ সম্বন্ধে সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যমেই দেখলাম, ২৫ অক্টোবর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে 'সম্প্রীতি বাংলাদেশ' নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে। ওই সম্প্রীতি সমাবেশে ৮৯টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা ঘোষণা করে। এমন সময়ে এত বড় অরাজনৈতিক একটি সমাবেশ সম্প্রীতি রক্ষায় আক্রান্তদের মনে শক্তি জুগিয়েছে। সংগঠনটির আহ্বায়ক নাট্যব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই। সম্প্রীতির বাংলাদেশ ২৫ অক্টোবর শহীদ মিনারে যে প্রতিবাদ সমাবেশ ঘটায়, তাতে নাকি বহুসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটেছিল। এই সংবাদ আশা ও শক্তির ক্ষেত্র বিস্তৃত করে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে যূথবদ্ধ হয়ে আরও সক্রিয় হবেন- এটাও প্রত্যাশা।

আমার স্নেহভাজন পূর্বোক্ত সাংবাদিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানায়, ওবায়দুল কাদের নাকি দলীয় নেতাকর্মীদের সামনে প্রশ্ন রেখেছেন- ভোটের সময় যাদের কাছে যাওয়া হয়, তাদের দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারার কারণ নিয়ে ভাবতে। ইতোমধ্যে কালের কণ্ঠের এক খবরে প্রকাশ (২৪.১০.২০২১)- হামলা ও উস্কানির নেতা ছাত্রশিবির থেকে আসা ছাত্রলীগ কর্মী সৈকত মণ্ডল- শেষ পর্যন্ত গাজীপুরে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার। আমরা তার শাস্তি দাবি করছি; আবার স্মরণ করছি বেশ আগে ওবায়দুল কাদেরের খেদোক্তি দলে 'কাউয়া' ঢোকা প্রসঙ্গে। পরিণাম যে ভয়ংকর হতে পারে- তার প্রমাণ বর্তমান হামলা। এখন সরকারপক্ষে বহু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু সার্বিক বিচারে দরকার দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও সমাজ বদল আর সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি, যাতে মানুষ গুজব ও উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হয়।

আগামী দিনে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রুখতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও দিক বদলের বিকল্প নেই। তাই অনেক উদ্ৃব্দতিতে না গিয়ে লেখা শেষ করি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম দিয়ে- 'কুমিল্লার ঘটনায় মূল সন্দেহভাজন শনাক্ত'/ 'গাজীপুরে মন্দিরে হামলার নেপথ্যে জামায়াত-শিবিরের তিন নেতা- সাইফুল ইসলাম, রবিউল হাসান ও লুৎফর রহমান' (সমকাল, ১৯-১০-২০২১)। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সমগ্র ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, যে আবেদন উৎপীড়িতদের, যে নির্দেশ হাইকোর্টের। ঘটনার গুরুত্ব বিচারে এ নির্দেশ পালন জরুরি মনে করি। শুধু গ্রেপ্তারই নয়; বিচার ও শাস্তি অতীব প্রয়োজন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চিন্তায়।

ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র-গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক