পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিকাণ্ড কতটা ব্যাপক ছিল- ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ঘণ্টার পরিশ্রম তা খানিকটা প্রমাণ করে। নিহত পাঁচ শ্রমিকের দেহ এতটা পুড়ে গেছে যে, তাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি। কিন্তু এর ভয়াবহতা কেবল অগ্নিকাণ্ডের মাত্রা ও নিহতের সংখ্যা দিয়ে বিবেচনার অবকাশ নেই। কারণ এদের অনেকেই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অনেকেই ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের একমাত্র সম্ভাবনা। বিষয়টি কেবল সংশ্নিষ্ট পরিবারগুলোর ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরিমাপ করা যাবে, তেমনও নয় অবশ্য। আমরা মনে করি, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা হলো, একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি ও জনবহুল এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো সরছে না।
আমরা দেখেছি, ২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পরই পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক কারখানা ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কঠোর অঙ্গীকার সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এক দশক পার হয়ে গেলেও ওই প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। স্বীকার করতে হবে, বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিক মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে একটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সমকালে শনিবার প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত ওই প্রকল্পের কেবল মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, মাটি ভরাটের কাজ শুরু হতেই যদি এক দশক পার হয়ে যায়, তাহলে মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে কত দশক প্রয়োজন হবে? আমরা এও জেনেছি, সিরাজদীখানে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক 'প্রস্তুত' হওয়ার আগ পর্যন্ত 'সাময়িকভাবে' রাসায়নিক কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির খালি জায়গায় স্থানান্তর করার কথা ছিল।
হতাশার বিষয়, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-বিসিআইসি পরিচালিত সেই অস্থায়ী প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অস্থায়ী ও স্থায়ী দুই প্রকল্পই দীর্ঘসূত্রতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই প্রশ্ন অমূলক হতে পারে না- পৃথক রাসায়নিক পল্লি পেতে হলে আর কত প্রাণ দিতে হবে? বস্তুত নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পরই যদি গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া হতো; তাহলে ২০১৯ সালে চকবাজারে, চলতি বছর এপ্রিলে আরমানিটোলায় কিংবা বৃহস্পতিবার সোয়ারীঘাটে এত জীবন ও সম্পদের হানি হতো না।
আমরা মনে করি, এখন খতিয়ে দেখার সময় এসেছে- কাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলায় নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর নেওয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন ঝুলে গেছে। বিসিক প্রকল্প কর্মকর্তা যতই সমকাল প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি না হোন; কাউকে না কাউকে দায় নিতেই হবে। আমরা জানি, রাসায়নিক কারখানা ও দাহ্য পদার্থের গুদাম পুরান ঢাকার জন্য এক 'বাণিজ্যিক বাস্তবতা'। এমনকি এ ধরনের ব্যবসার জন্য ভবন ভাড়া দিলেও মেলে সবচেয়ে বেশি দাম। ফলে নগর থেকে দূরে প্রস্তাবিত রাসায়নিক পল্লি চালু করার ক্ষেত্রে অনুৎসাহ বহুমুখী হয়ে পড়তেই পারে। এমনকি উদ্যোগটি দীর্ঘসূত্র করে তুলতে অনৈতিক লেনদেনও হতে পারে।
আমরা দেখতে চাইব, সব দিকই খতিয়ে দেখা হয়েছে। ক্ষুদ্রতর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থে বৃহত্তর নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে এভাবে একটি নগর চলতে পারে না। সোয়ারীঘাটের অগ্নিকাণ্ডে আমরা নিশ্চয়ই শোকাহত। কিন্তু কেবল শোক ও অশ্রুপাতেই এ সংকটের সুরাহা হবে না। সরকার নিশ্চয়ই নিহতদের পরিবার ও স্বজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিষয়টি নিছক ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যাপার নয়। দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন। অস্বীকার করা যাবে না যে, কমবেশি দুই কোটি অধিবাসীর এই নগরের নিরাপত্তা বিধান সহজ নয়। কিন্তু আর কিছু না হোক, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়ানো খুব কঠিনও নয়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বারংবার বলে আসছেন, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা আলাদা করতে হবে। শহরের ভেতর থেকে সরিয়ে নিতে হবে কল-কারখানা। যত দ্রুত সম্ভব রাসায়নিক পল্লি চালু করার মধ্য দিয়েই সেই জরুরি কাজ সূচিত হোক; আরেক দফা বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা না করেই।
মন্তব্য করুন