মাত্র ২৪ বছর আয়ুস্কাল পাওয়া মোটর শ্রমিক নূর হোসেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম প্রতীক। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মিছিলে যোগ দেন নূর হোসেন। তার বুকে-পিঠে লেখা ছিল 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। ওই মিছিলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের পাশে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

রক্তাক্ত ইতিহাস বাঙালির। যে ইতিহাসের পর্বে পর্বে ত্যাগের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাঙালির সূর্য সন্তানরা। আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। '৭১-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ। বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসে যারা রক্ত দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই সাহসী দেশপ্রেমিকদের গর্বিত উত্তরসূরি নূর হোসেন।

নূর হোসের সেই আত্মত্যাগ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ধারায় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর পতন হয় এরশাদের। এর মধ্য দিয়ে এরশাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের অবসান ঘটেছিল। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। কিন্তু নূর হোসেন আত্মদানের প্রায় তিন যুগ হতে চলল, এই সময়ের মধ্যে কত আন্দোলন হলো, হরতাল হলো, আরও কত নূর হোসেন প্রাণ বিসর্জন দিল কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না সাধারণ মানুষের জীবনে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হলো না।

মূলত, এরশাদ পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় এলেও তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি অবহেলা লক্ষ্য করা গেছে। একবার ক্ষমতায় আসতে পারলে দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে ততটা গুরুত্ব দেয়নি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে। ফলে রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রতিহিংসা আরও জোরালো হয়েছে। রাজনীতির নামে জেঁকে বসেছে কর্তৃত্ববাদ। যখন যারা ক্ষমতায় বসেছে তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের স্বার্থে সাজিয়েছে। যা অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং করছে।

নূর হোসের আত্মদানের পরবর্তী সময়ে দেশে গণতন্ত্র ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়েছে। গণতন্ত্রে নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সর্বাধিক। এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার সুবিধামতো সরকার নির্বাচন করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে জনগণ এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জালভোট, কারচুপি, ভুয়া ভোটার প্রভৃতি অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এক জোট হয়ে এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল।

গণতন্ত্রের বড় প্রতিবন্ধক দুর্নীতি। জীবনের বিনিময়ে পাওয়া গণতন্ত্রে দুর্নীতি কাম্য হতে পারে না। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নেই। আমরা পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। দুর্নীতির আন্তর্জাতিক সূচকে আমরা এখনও তলানিতে পড়ে আছি। ক্রমেই দুর্নীতি বাড়ছে। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, কালোবাজারিসহ নানা নীতি বিবর্জিত কর্মকাণ্ড জনজীবনকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কোথাও যেন কোনো জবাবদিহি নেই, নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

সমাজ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য, অপরাধকর্ম, খুন, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ নানা জনস্বার্থ বিবর্জিত কর্মকাণ্ড। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে। দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। নূর হোসেনের ত্যাগের বিনিময়ে এই গণতন্ত্র, এই সমাজ তো আমরা চাইনি। নূর হোসেনের মতো শহীদরা তো এই বৈষম্য, প্রতিহিংসা আর অস্থিরতার জন্য আত্মত্যাগ করেননি। শহীদ নূর হোসেন দিবস পালনের সময় সেই কথা আমরা কি মনে রাখি?