
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে ৩১ অক্টোবর থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'কপ২৬' সম্মেলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, পরিবেশবাদী সংগঠন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ 'মানব জাতি ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে'- এই শঙ্কা এবং এর থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে নেট শূন্য নির্গমনের আশা নিয়ে যোগ দিয়েছেন এই জলবায়ু সম্মেলনে।
এবারে গ্লাসগোর আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে নেট শূন্য নির্গমন। একটু পর্যালোচনা করা যাক শূন্য নির্গমন অর্জন আসলে কী। শূন্য নির্গমন বলতে বোঝায়, বায়ুমণ্ডলে কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত না হওয়া। নেট-শূন্য নির্গমন অর্জনের অর্থ হলো, কিছু গ্রিনহাউস গ্যাস এখনও নির্গত হয়, তবে বায়ুমণ্ডল থেকে সমপরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারিত হয়ে মাটি, গাছপালা বা বিভিন্ন উপকরণে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়। নেট শূন্য বিষয়টি বায়ুমণ্ডলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ এবং বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারিত পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য নির্দেশ করে। শূন্য নির্গমন অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে, যেহেতু নির্গমনের কিছু উৎস সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা ব্যয়বহুল কিংবা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাই নেট-শূন্য নির্গমন অর্জনকে দেশব্যাপী শূন্য নির্গমন অর্জনের চেয়ে বেশি সম্ভাব্য বলে মনে করা হয়।
অর্থনীতির চাকার গতি বাড়িয়ে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিযোগিতা, সেটাই এই অনিয়ন্ত্রিত নির্গমনের প্রধান কারণ। কিছু রাষ্ট্র তাদের উন্নয়নকে উন্নত মাত্রায় নিতে মাত্রাহীন দূষণ করেছে এবং উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। উন্নতিকে ধরে রাখতে এখনও ভোগ এবং দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও টেকসই উন্নয়নের কথা বলে দেশগুলো পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারসহ নানান পদক্ষেপের কথা বলছে এবং বিশ্বের দরিদ্র কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এক কাতারে শামিল হতে বলছে। কিন্তু এতে আদতে কতটুকু লাভ হচ্ছে, সেটা ভাবার বিষয়। অপেক্ষাকৃত কম খরচে কয়লাভিত্তিক শিল্পকারখানার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে যেসব দেশ দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে, সেসব দেশ যখন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল জ্বালানি ব্যবহারের প্রেসক্রিপশন দেয়, সেটা গৃহীত না হওয়ার শঙ্কাই বেশি। ভারত, চীন কিংবা অস্ট্রেলিয়া এবারের কপ২৬-এ শিল্পকারখানায় কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার প্রস্তাবনাকে না করে দিয়েছে। হয়তো অনেক উন্নয়নশীল দেশ উপায়ান্তর না পেয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় শেষ পর্যন্ত শিল্পে কয়লার ব্যবহার করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটুকু হবে দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো নিজ অর্থায়নে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করে কলকারখানা ও যানবাহন চালুর ব্যবস্থা করে দিলে একটি সুরাহা হতে পারে। কিন্তু তেমনটা আগে যেমন হতে দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও হবে, এমন কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেক দেশের সরকার এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য নির্গমন নির্ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নেট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য পরবর্তী ৩০ বছরে শূন্য দশমিক ২ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য নেট নির্গমন কমাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারে তবে এটি বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন প্রায় ১০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। যুক্তরাজ্য ২০১৯ সালে তাদের সংসদে আইন পাস করে ঠিক করে নেয়, ২০৫০ সালের মধ্যে তারা নেট নির্গমন ১০০ শতাংশ কমাবে। যুক্তরাজ্য বিশ্বের প্রথম প্রধান অর্থনীতি, যারা এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বকে টেকসই উন্নয়নের একটি পথ দেখাল। বিশ্ব চাচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ নির্গমনের হারকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে। কিন্তু কপ২৬-এ এসেও তো ঐকমত্য দেখছি না।
তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উন্নতির শিখরে উঠে যখন বিশ্ব-মোড়ল, তখন উন্নয়নের দৌড়ে যারা উন্নতদের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে, তারা চাচ্ছে না জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে তাদের উৎপাদন ও অর্থনীতির গতি শ্নথ করতে। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের শীর্ষে চীন, যেখান থেকে কিনা আসে বিশ্বের মোট নির্গমনের ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর পরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (১৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) ও ভারত (৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ )। এর মধ্যে নির্গমনকারী প্রধান দেশ চীন ও ভারত সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া (১ দশমিক ১৬ শতাংশ) এবারের কপ২৬ সম্মেলনে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে- তারা কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসবে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের উৎস এখনই নিষ্ফ্ক্রিয় করা যাচ্ছে না। তবে যারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসতে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সম্মত হয়েছে, তারা কীভাবে এটি করতে পারে সেটাও অনেকের কাছে হয় স্পষ্ট নয় অথবা ব্যয়বহুল মনে হচ্ছে। যেমন বাংলাদেশ, যার বিশ্ব গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে শেয়ার মাত্র শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে দেশটি তার খুব কি কিছু করার আছে? বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে টিকে থাকবে, সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে।
বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন এখনই কমানো শুরু করে নেট শূন্যতে আনতে না পারলে এবং বর্তমান গতিতে নির্গমন চলতে থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে, যা পৃথিবীকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। অতএব, এখনই সময় নেট শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সোচ্চার হওয়ার। না হয়, উন্নয়নে বিভোর হয়ে সীমাহীন গ্রিনহাউস নির্গমনের মাধ্যমে যেভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তোলা হচ্ছে, সে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে কল্পিত সুখ।
অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
saifullahasm@yahoo.com
মন্তব্য করুন