বানানটা ভুল লিখেছিল। আর এই ভুলই বলে দেয়- সে এ দেশের আমজনতার একজন, অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তবে ইতিহাস তাকে বানিয়েছে গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামের অক্ষয় এক প্রতীক। তাকে নিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি লিখেছেন অমর কবিতা। সে কবিতার নাম 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়'।
সেই বুকে, ২৪ বছরের এক যুবকের জামা খুলে কোমরে পেঁচিয়ে রাখা শ্যামলা উদোম বুকে সাদা রঙে লেখা ছিল 'স্বৈরাচার নীপাত যাক', আর পিঠে 'গনতন্ত্র মুক্তি পাক'। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর হেমন্তের রোদ-ঝকঝকে দুপুরে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে উত্তাল গণআন্দোলনে মিছিলে ছিল সে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। বুকে-পিঠে লেখা ছিল বলে পুলিশ নিশানা করেই তাকে মেরেছে, ধারণা করা হয়। স্বৈরতন্ত্রের নিপাত ও গণতন্ত্রের মুক্তি কামনা করে সুস্পষ্ট প্রত্যয় বুকে-পিঠে লিখে মিছিলে আসা এই তরুণের নাম নূর হোসেন। পরে তার সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে। অল্প লেখাপড়ার পরেই সে রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজে লেগেছিল। বাবা ঢাকা শহরে অটোরিকশা বা স্কুটার চালিয়ে সংসার নির্বাহ করতেন।
নূর হোসেনের এমন আত্মদান এরশাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবল গতি সঞ্চার করে। তার ছবি দিয়ে বানানো পোস্টার হয়ে ওঠে রাজপথে এক প্রভাবক শক্তি। এরশাদের প্রায় ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একাধিকবার ঢেউয়ের মতো ওঠা-পড়া আন্দোলনে অনেক ছাত্র-তরুণ ও নাম জানা-অজানা মানুষ শহীদ হয়েছে। নূর হোসেন ও পরে ১৯৯০ সালে এরশাদ সমর্থক গুন্ডাদের গুলিতে নিহত ডা. শামসুল আলম খান মিলনের নাম ওই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অক্ষরে ভাসছে। ওই বছরই এরশাদের পতন ঘটে। কোনো শহীদেরই মর্যাদা খাটো করে দেখা যায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যায়যুদ্ধে আত্মদানকারী সেনাপতিদের নাম-পরিচয় স্পষ্টই থাকে। সৈনিকদের অনেককে অজ্ঞাতনামা বলে স্মরণ করতে হয়। নিরস্ত্র জনতার গণআন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে বিশিষ্ট ক্ষণ ও পরিবেশ, ব্যক্তিগত ভূমিকা, আত্মদানের স্পৃহা ও পটভূমি প্রভৃতি কারণে ইতিহাসে শহীদদের স্থান ও স্মরণের স্থায়িত্ব নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নূর হোসেন মেহনতি শ্রেণির একজন সচেতন অংশগ্রহণকারী। কোনো সংগঠনে সংঘবদ্ধ না হয়েও বন্ধুদের নিয়ে এসেছিল জনতার মিছিলে।
দেশের অনেক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের তিনটি জোটের যুগপৎ কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়েছিল তখন সামরিক শাসনের মধ্যে দল গঠন করে নানা ছলচাতুরীতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এরশাদের অতিমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রসহ কয়েক দফা গণদাবি নিয়ে। সেই জোটগুলো ছিল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ ৮ দল; পূর্ববর্তী আরেক সামরিক শাসকের গড়ে তোলা বিএনপিসহ ৭ দল, জাসদসহ বামপন্থিদের ৫ দল। এ রকম পরিচয় হলেও জোটগুলোতে দলের সংখ্যা বিভিন্ন সময় ওঠা-নামা করেছে। এরশাদের সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আগেই জোটগুলোর আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর ছিল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি। সরকারই লোকসমাগম বন্ধের জন্য গণপরিবহন আটকে এমন ব্যবস্থা করে যে, হরতালের মতো অবস্থা তৈরি হয়।
২.
ইতিহাসের নূর হোসেনকে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ থেকে বিযুক্ত করতে পারি না। তখন সাপ্তাহিক একতায় কাজ করি। সবাই জানেন, এটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সাপ্তাহিক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। অফিস পুরান ঢাকার বংশাল রোডে। স্বাধীনতার পরের বছরই যে নবীন আলোকচিত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয়, ১৯৭৭ সালে আমার স্বল্পকালীন কর্মস্থল সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদনা-কাণ্ডারী কবি বেলাল চৌধুরী যার ছবি তোলার উদ্দীপনাকে ঘাসফড়িংয়ের লাফিয়ে চলার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, সেই পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান তখন ইংরেজি নিউ নেশনের ফটোগ্রাফার, কিন্তু আমাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ। ১০ নভেম্বরের সেই উত্তেজনায় ঠাসা দিনশেষের সন্ধ্যায় সে আমাকে ফোন করে জানাল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ঘাসের ওপরে পড়ে থাকা একটি ডেডবডিতে নাকি গায়ে কী লেখা আছে। তার কাছে মিছিলে তোলা তো সে রকম একজনের ছবি আছে। আমাকে আরও খোঁজ নিতে বলল পাভেল। আমি বললাম, আমার জন্য একটা প্রিন্ট রেখো, দিতেই হবে। পরে আমি মোটরসাইকেলে ইত্তেফাক অফিসের ডার্করুমে গিয়ে ওর কাছ থেকে ছবিটি নিয়ে আসি। শুনি, অনেক কৌশল করে সে একই ডার্করুমে কাজ করা বাঘা ফটোসাংবাদিক ইত্তেফাকের রশীদ তালুকদার ও মোহাম্মদ আলমের নজর থেকে নেগেটিভটি বাঁচিয়েছে। পরের দিন শুধু নিউ নেশনেই প্রথম পাতায় ছবিটি ছাপা হয়েছিল। মিছিলে নূর হোসেনের পিঠে লেখা 'গনতন্ত্র মুক্তি পাক'। পাভেল তার বইতে লিখেছে সেদিনের কথা, ঐতিহাসিক ছবিটির জন্মকথা। ছবিটি তথ্যগতভাবে শহীদের নামসহ শনাক্ত করেন নিউ নেশনের রিপোর্টার খন্দকার তারেক। আমরা একতায় স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নিজেরা শনাক্ত করার দুর্বলতা চিন্তায় ছোট করে পেছনের পাতায় ছেপেছিলাম। পরে ছবিটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায় এবং অসংখ্য জায়গায় অসংখ্যবার ছাপা হয়।
বনগ্রামের দরিদ্র ঘরে বাবা-মা-ভাইবোনের সঙ্গে বসবাসকারী নূর হোসেন নিজের গায়ে স্বপ্নের কথা স্লোগানে লিখে মিছিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আগের রাতে ঘর ছেড়ে মতিঝিলের একটি নির্মাণাধীন দালানে এক বন্ধুকে নিয়ে রাত যাপন করে। ওই বন্ধুই তার গায়ে রং লেপে লিখে দেয়। বাবা-মা খুঁজতে এলে চাদর গায়ে ঢেকে রেখে নূর হোসেন মিছে কথা বলে ওদের ফিরিয়েছিল। এসব কথা ধীরে ধীরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
৩.
নূর হোসেনের আত্মত্যাগের পর ৩৪ বছর পার হয়েছে। বছর বছর নূর হোসেন দিবস পালিত হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রশ্ন- বুকে-পিঠে লেখা সরল ভাষার সেই আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ হয়েছে? স্বৈরাচার বলে যে ব্যবস্থায় জনগণের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এসেছিল, তার একটি মাত্রার অবসান এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতি ও ১৯৯১-এর নির্বাচনের মাধ্যম রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ছেড়ে জনকাঙ্ক্ষিত সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। স্বৈরাচারের নিপাত ঘটলেও স্বৈরাচারী এরশাদ রয়ে গেলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে; নানা ঘটন-অঘটন, দরকষাকষিসহ নেপথ্য-প্রকাশ্য বিভিন্ন ভূমিকায় আরও ৩০ বছর নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মর্যাদাপূর্ণ পদ ও রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পেয়ে গেলেন। এখানেই গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে বর্তমান রাজনীতিবিদদের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ভেতরের ফাঁক ও দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিন জোটের রূপরেখা ভুলে যাওয়া এর মধ্যেই পড়ে।
আর গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? গণমানুষের একজন অতিসাধারণ শ্রমজীবী নূর হোসেনের পিঠে লেখা স্লোগানের এ কথাটির ব্যঞ্জনা অনেক। গণতন্ত্র আছে। আছে? যে গণতন্ত্র আছে, সে নিজে কতটা মুক্ত ও কতটা নানা বেড়াজালে বন্দি- তা দেশবাসীর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। নির্ভয়ে, মুক্তমনে, নিরাপদ পরিবেশে একজন নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন গঠনের সুষ্ঠু নিয়মনীতি ও প্রক্রিয়া, বিরোধী দলের সত্যিকার ভূমিকাসহ জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা, প্রকৃত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাসহ মুক্ত সংবাদমাধ্যম- এই প্রতিটি প্রশ্নে বিচার করতে হবে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কিনা। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে বাংলাদেশকে কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক