- মতামত
- মেডিকেল রিপোর্টই ধর্ষণ প্রমাণের একমাত্র দলিল?
সমকালীন প্রসঙ্গ
মেডিকেল রিপোর্টই ধর্ষণ প্রমাণের একমাত্র দলিল?

নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সহিংসতার বহুমাত্রিক দিকের মধ্যে একটি নৃশংসতম দিক হলো ধর্ষণ। ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে ১১৭৮ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী। আট নারী ধর্ষণ-পরবর্তী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। ১১৭৮টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে ৮১৩টি। নানা কারণে ধর্ষণের ঘটনা সঠিক সময়ে রিপোর্ট করা থেকে ভুক্তভোগী বিরত থাকেন। তার মধ্যে 'ফ্রিজ অ্যান্ড ফা'ন রেসপন্স', মানহানির ভয়, সমাজের 'ভিকটিম ব্লেমিং' প্রবণতা এবং ভুক্তভোগীর চরিত্র হননের চেষ্টা, ধর্ষণের প্রমাণ দিতে অস্বস্তিবোধ, পারিবারিক অসহযোগিতা অথবা প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারের কাছে গোপন করে যাওয়া, পুনরায় ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে ন্যায়বিচার পাওয়ার সীমিত সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য।
উপরোক্ত কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ভিকটিম ব্লেমিং প্রবণতা। এখনও ধর্ষণের শিকার নারী কেমন, তার বিচরণক্ষেত্র, তার পোশাক, ধর্ষণের প্রেক্ষাপট বিশ্নেষণ, ঘটনার স্থান, কাল এবং ওই স্থানে ভুক্তভোগীর গমনের কারণ ইত্যাদি বিষয় ধর্ষণ প্রমাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ, ধর্ষক কেন তার মেয়ে বান্ধবীকে নিয়ে এমন একটি স্থানে গমন করল, তার খারাপ উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সে কোন কোন ধরনের নেশায় আসক্ত, তার অতীত কর্মকাণ্ড বিশ্নেষণ, তার নামে আর কোনো ধর্ষণ মামলা রয়েছে কিনা, তার অপরাধ কর্মের অন্য কোনো প্রমাণাদি আছে কিনা- সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমাজের এমন বিচার-বিবেচনার কবলে পড়ে ভুক্তভোগী নিজেকেই দায়ী ভাবতে শুরু করের এবং নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান। এই গুটিয়ে যাওয়া মানে মেনে নেওয়া নয়, এই গুটিয়ে যাওয়া মানে মনের মধ্যে পুষে রাখা অমানুষিক যন্ত্রণা আর ক্ষণে ক্ষণে গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একটি অবচেতন আত্মার অব্যক্ত আর্তনাদ। যার ফলে ঘটে যায় অনেক আত্মহননের ঘটনা।
একজন নারী যৌন মিলনের যে কোনো পর্যায়ে অমত প্রকাশ করার পর যদি তাকে সেই কর্মকাণ্ড সম্পাদনে বাধ্য করা হয়, তবেই তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন যৌনকর্মীও তার ক্লায়েন্ট দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন অথবা একজন স্ত্রী তার স্বামী দ্বারা। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের স্থান-কাল-পাত্র, ধর্ষিতার পোশাক, বয়স, চরিত্র কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া ১১৭৮টি ধর্ষণের ঘটনায় ৩৭৪ জনই ছিল শিশু। এদের মধ্যে ১৯৯ জনের বয়স ১২ বছর বা তার থেকে কম। সুতরাং এতদিনে সমাজের বোধোদয় হওয়া উচিত যে, ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার পোশাক বা চরিত্রের কোনো ভূমিকা নেই।
ঢাকার রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণের ঘটনায় পাঁচ আসামির খালাসের ঘটনা জাতিকে করেছে স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৩৮ দিন পর মামলা করায় ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আসামিরা সব খালাস পেয়ে যায় এবং এ ধরনের আলামতহীন চার্জশিট দাখিল করে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করায় আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেন। এমনকি আদালত ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামতসহ মামলা গ্রহণ করার নির্দেশনা দিয়েছে। এই বিচারের মাধ্যমে আদালত আলামতহীন ধর্ষণের মামলা অথবা মামলা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পরোক্ষ নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অথচ ইতিহাস বলে, ধর্ষণের ঘটনায় বিলম্বে মামলা করা একটি সাধারণ এবং অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ভুক্তভোগীর 'ফ্রিজ রেসপন্স' অনেক সময় এই বিলম্বের জন্য দায়ী হয়ে থাকে। ধর্ষণের ঘটনার পর ভুক্তভোগী তার সব মানসিক এবং শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় তার পক্ষে ধর্ষণের প্রমাণাদি দাখিল করতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এসব ক্ষেত্রে মামলা করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বছরও গড়িয়ে যায়। তাই বলে কি তিনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন? তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণের জন্য মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়াও আরও নানাবিধ উপায় রয়েছে। ঐতিহাসিক ধর্ষণের ঘটনায় নানা উপায়ে আলামত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার নারী যদি তার খুব নিকটজন বা আস্থাভাজন কারও সঙ্গে ঘটনাটি শেয়ার করে থাকেন, তবে সেই ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া এখন আইন এবং ঘটনা অনুসন্ধানের উপায় অনেক আধুনিক এবং সময়োপযোগী হয়েছে। বর্তমানে সিসিটিভি ফুটেজ, অভিযুক্তের ফোনালাপসহ নানা বিষয় বিশ্নেষণের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া ভুক্তভোগীর চরিত্র বিশ্নেষণ না করে বরং ধর্ষকের চরিত্র বিশ্নেষণ এবং তার অতীত কর্মকাণ্ড ধর্ষণের ঘটনার সত্যতা প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
'সেক্স ক্রাইম'-এর ক্ষেত্রে বিলম্ব বলে কোনো শব্দ থাকা উচিত নয়। যে নারী ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন, তার পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভুক্তভোগীর পক্ষ হয়ে মামলা পরিচালনা করে থাকে। যেখানে এমন ঘটনার বিধান রয়েছে, সেখানে ৭২ ঘণ্টা কি ৭২ দিন কোনো অর্থ বহন করে না। ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে সমাজে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে মামলা করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা, ভয় কিংবা বিলম্ব কোনোটাই দূর করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। এর বাইরে পারিবারিক সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।
অবশ্যই সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত বিচারকার্য পরিচালনা করবেন, তবে ধর্ষণের মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্টকে একমাত্র দলিল বলে বিবেচনা করা অত্যন্ত সেকেলে এবং অগ্রহণযোগ্য।
সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন