গ্যাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল যেভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সোমবার সমকালে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে শুধু নারায়ণগঞ্জেই পাঁচশ দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বস্তুত চিত্রটি নারায়ণগঞ্জের হলেও সারাদেশের চিত্র মোটেও সুখকর নয়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের মনে আছে, গত বছর সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে গ্যাস বিস্ম্ফোরণে ৩৪ জন মুসল্লি প্রাণ হারান। সর্বশেষ শুক্রবার ফতুল্লারই একটি পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় জমে থাকা গ্যাসের বিস্ম্ফোরণে দুই নারী নিহত হন। এর আগে আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুরে গ্যাসলাইন মেরামতের সময় বিস্ম্ফোরণে ৪ জনের বেদনাদায়ক মৃত্যু হয়। আমরা মনে করি, গ্যাসের এসব বিস্ম্ফোরণ নিছক দুর্ঘটনা নয়। এর দায় তিতাস গ্যাসের সংশ্নিষ্টরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, শুক্রবারের অঘটনে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের ধারণা- অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণেই ফ্ল্যাটের চুলার চাবি বন্ধ করা হয়নি। পরে রাতের যে কোনো সময় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে রান্নাঘরটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয় এবং সেখানে আগুন জ্বালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। গ্যাস সরবরাহের এ দুরবস্থা চলতে থাকলে দুর্ঘটনা কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হবে না। বলাবাহুল্য, আমরা দেখেছি শুধু তিতাসের লাইন থেকেই গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে না। বরং বাসাবাড়িতে ব্যবহূত এলপিজি সিলিন্ডার থেকেও বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটছে। চলতি বছর জুনের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবনের নিচতলার রেস্টুরেন্ট থেকে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় ১২ জনের হতাহতের ঘটনা এখনও জ্বলজ্বলে। বিস্ম্ফোরণের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে, এটি একই সঙ্গে ৭টি ভবন এবং রাস্তায় থাকা ৩টি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাসাবাড়িতে এলপিজিসৃষ্ট দুর্ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশ হয়। গ্যাস বিস্ম্ফোরণের সেসব অঘটনের প্রতিটিই ভয়াবহ। একেকটি দুর্ঘটনায় একসঙ্গে অনেক জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়। গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহের পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্যাস বিস্ম্ফোরণের কারণ গ্যাসলাইনে লিকেজ থাকা ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার। গ্যাসের উল্লেখযোগ্য সংযোগই নাজুক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ গ্যাসলাইন একবার বসানো ও সংযোগ দেওয়ার মাধ্যমেই কর্তৃপক্ষ দায় সারে। এর পর খোঁজ নেওয়া দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের ডাকে সাড়া না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। গ্যাসসৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে গ্রাহকের সচেতনতার বিষয়টি অস্বীকারের উপায় নেই। গ্যাস ব্যবহারের পর চুলা বন্ধ করে রাখা, রান্নাঘরের জানালা খুলে রাখাসহ সিলিন্ডারে আগুন লাগলে কীভাবে নেভাতে হয় ইত্যাদি সচেতনতা জরুরি। নিম্নমানের চুলা ও রাইজার ব্যবহারও বন্ধ করা জরুরি। তবে গ্যাসের বিস্ম্ফোরণ এবং গ্যাসসৃষ্ট দুর্ঘটনা বন্ধে কর্তৃপক্ষকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজধানী ও এর আশপাশে তিতাস কোম্পানি গ্যাসের সংযোগ দেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে যেমন অর্ধশত বছরের পুরোনো লাইন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

এমনকি ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, রাজধানীতে অগ্নি-দুর্ঘটনার ৩৯ শতাংশই ঘটে গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে। অবৈধ সংযোগ গ্যাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। গত এক দশক গ্যাসের সংযোগ বন্ধ থাকলেও বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগ-বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। আমরা মনে করি, গ্যাসের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতেই হবে। গ্যাসের বিস্ম্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের অনীহা স্পষ্ট। এমনকি সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনীহায় নারায়ণগঞ্জের ৩৪ জনের মৃত্যুর বিচার শুরু করা যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে একের পর এক গ্যাস দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, তা আর চলতে দেওয়া যায় না। আমরা প্রত্যাশা করি, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবে। গ্যাসের লাইন নিয়মিত পরিদর্শনসহ গ্রাহক সচেতনতায় কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে।