একটি যুগের অবসান হলো। যুগটি ছিল মেধা, মনীষা, অসম্ভব সৃজনশীল চিন্তা এবং সংস্কৃতির ভেতরের শক্তিকে গ্রহণ করে ব্যক্তি ও সমাজকে তৈরি করবার সময়। হাসান আজিজুল হক গদ্য লিখেছেন, যার তুলনা বাংলা ভাষায় পাওয়া কঠিন। সেই গদ্যে তার নিজ শৈশবের মাটি ও মানুষের ছায়াপাত, বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের নিসর্গের ছায়াপাত ঘটেছে। হাসান আজিজুল হকের শব্দেরা তাই এত বাঙ্‌ময়।

হাসান আজিজুল হকের গল্প ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করবার যতটা সুযোগ করে দেয়, ঠিক ততটাই বাংলাদেশের প্রকৃতির ভেতরকার আলোছায়ার রহস্যময়তাও উন্মোচন করবার সুযোগ করে দেয়। জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল এবং জীবনের বিচিত্র সব কণ্ঠস্বরকে ধারণ করে শব্দকল্প তৈরির প্রকৃষ্ট উদাহরণ তার গদ্য। হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' একেবারে বর্ধমানের কথ্যভাষায় সাজানো, অথচ একই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ভাষারও নিশ্চিত প্রতিধ্বনি।

'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পে লোকজীবনের গভীর দ্বন্দ্ব-সংকটগুলো যেভাবে উঠে আসে, তার সঙ্গে শহরের একটি সমান্তরাল পরিবারের দ্বন্দ্ব-সংকটের পার্থক্য আমি পাই না। কী জাদুকরি ভাষায় এই গল্পের কাঠামো, বহমানতার অসম্ভব রসায়ন, গল্পের সমাপ্তির চমক- সব মিলিয়ে পাঠকের মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী অনুরণন তৈরির ক্ষমতা যে কোনো ভাষাতেই কম কথাশিল্পীর আছে।

তিনি দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন, দর্শনকে তিনি প্রতিদিনের কথোপকথনের মতো সহজ করে নিয়েছেন; আবার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাগুলো তিনি দর্শনের গভীরতায় প্রতিস্থাপন করেছেন। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছিল একই সঙ্গে আনন্দ, জানাশোনার পরিধি বাড়ানো এবং অনেক দুরূহ সত্যের মুখোমুখি হওয়ার অনিঃশেষ এক অভিজ্ঞতা। এসবই ছিল তার সময়ের এবং তার সৃষ্টি।

হাসান আজিজুল হক চলে যাওয়া মানে একসময়ের ওপর কালের পর্দা পড়ে যাওয়া। খুব বড় শিল্পী না হলে সময়কে এভাবে নিজস্ব অর্জনের বিষয়ে পরিণত করা সম্ভব হতো না। আর নিজের ভাষায় নিজের সময়কে সাহিত্যে উপস্থাপন হাসান আজিজুল হকের মতো বড় শিল্পীর পক্ষেই কেবল সম্ভব।

শিল্পী চলে গেলেন, কিন্তু উদাহরণ রেখে গেলেন। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য চিরদিনের, বাংলা ভাষার চিরস্থায়ী সম্পদ।