
সমকালে ২০ নভেম্বর প্রকাশিত 'এক গাছে পাঁচবার ধান!' বিষয়ক শিরোনামটি আমার মতো নিশ্চয়ই আরও উদ্ভিদ প্রজননবিদসহ অনেকের দৃষ্টিতে পড়েছে। এ রকম ধান জাত উদ্ভাবনের খবর মাঝেমধ্যেই আমরা পত্রিকায় দেখেছি। সে সবই ছিল ড. আবেদ চৌধুরীর ধান গবেষণার ক্রম সফলতার কথা। এবার তা এসেছে আরও খানিকটা বিস্তৃত রূপে এবং পত্রিকার প্রথম পাতায় লিড নিউজ হিসেবে। ফলে গবেষণালব্ধ এ ধানের বিষয়ে আলোচনাটা জরুরি হয়েই পড়েছে। খবরটা ভারি চমকপ্রদ কোনো সন্দেহ নেই। এক গাছে পাঁচবার ধান! একটি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন (!) রয়েছে শিরোনামটিতে। কারণ এটি অবাক হওয়ার মতোই একটি ঘটনা।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী তার জন্মস্থান মৌলভীবাজারের কানিহাটি গ্রামে এ ধান উদ্ভাবন করেছেন। এ ধান জানুয়ারি ২০২১ সালের বোরো মৌসুমে প্রথম চাষ করা হয়। সে মাসের প্রথম সপ্তাহে ১১০ দিন পর সে ধান প্রথম কর্তন করা হয়। এর ৪৫ দিন পর এর দ্বিতীয়বার ফসল সংগ্রহ করা হয়। এরপর প্রতি দেড় মাস পরপর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমবার ধান সংগ্রহ করা হয়। প্রথমবার ১১০ দিন প্লাস, এরপর ৪ দেড় মাস মানে ৬ মাস অর্থাৎ ১৮০ দিন। মোট ২৯০ দিনে এর পাঁচবার ফসল সংগ্রহ করা যায়। তার মানে, বছর পেরুতে আরও বাকি থাকল ৬০ দিন। ফলে আরও একবার ধান সংগ্রহ করতে পারলে বছরজুড়েই পাওয়া যাবে ধান ফসল উদ্ভাবিত এসব জাত থেকে। সে কাজই চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষক ড. আবেদ চৌধুরী। বলা বাহুল্য, এ গবেষকের কোনো ধান জাত কিন্তু এখনও দেশে ছাড়করণ করা হয়নি। ফলে এ উদ্ভাবনের জন্য সফলতা অর্জন করতে হলে এবং এ দেশের গরিবদের জন্য এ উদ্ভাবন বিলিয়ে দিতে হলে যেতে হবে আরও বেশকিছু দূর।
সে আলোচনা করার আগে এ রকম ধান উদ্ভাবনের কারণ কী সেটি জানা দরকার। কারণের খানিকটা আভাস পেলাম তার উক্তিতেই- 'আম-কাঁঠালের মতো বছরের পর বছর টিকে থাকার সৌভাগ্য ধান গাছের হয় না, এটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। তাই নেমে পড়ি গবেষণায়।' বিজ্ঞানীদের কত সব ভাবনা থাকে! সেসব থেকেই উদ্ভাবনের পথ খুঁজে নেন তারা। তাদের ভাবনার সঙ্গে সাধারণের ভাবনা মেলাবার কোনো উপায় নেই। ড. চৌধুরী বছরব্যাপী একবার রোয়ে দেওয়া ধান থেকে পাঁচবার ফসল সংগ্রহ করতে পারছেন। এখন একে ছয়বারে নিয়ে যেতে পারলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। কৃষিবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এবং একজন কৃষি উন্নয়ন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি এ বিষয়টাকে খানিকটা হলেও বিশ্নেষণ করতে চাই।
পাঁচবার বা ছয়বার বছরে একটি ধানি জমি থেকে ফলন লাভ কিন্তু বেশ বড় একটা কাজ। এখন দেখতে হবে এ থেকে কতটা ফলন আমরা বছরে পাই। সেটি বলতে হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে 'ক্রপ কাটিং'-এর নিয়ম মেনে। বিশেষ করে যখন পত্রিকায় এ খবরটিও এসেছে যে, পাঁচবার ফলন মিলিয়ে এর উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। যদি বাংলাদেশের ধানের গড় ফলন হিসেব ধরি হেক্টরপ্রতি চার টন তাহলে পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী পাঁচ গুণ বেশি উৎপাদন হলে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ২০ টন। যদিও বাংলাদেশে কেবল বোরোতে সাত-আট টন হেক্টরপ্রতি ফলন দিতে সক্ষম ধানের জাত রয়েছে একাধিক। তা সত্ত্বেও হেক্টরপ্রতি ধানের ২০ টন উৎপাদন ৯ মাসে মন্দ নয় কিছুতেই। বরং খানিক আশা জাগানিয়া বলেই মনে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবার ফসল সংগ্রহ করার সময় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের হিসাবটা কিন্তু নিতে হবে। তাছাড়া যেমনটি বলেছেন গবেষক সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে কেমন ফলন দেয় এসব লাইন সেটিও দেখতে হবে গভীরভাবে।
ধান গাছের ধান পেকে গেলে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় গাছ কেটে ফসল সংগ্রহ করে যদি বাকি নাড়াসহ ধান গাছ মাঠে রেখে দিয়ে পানি ও সার দেওয়া হয় তবে তা থেকে আবার ধান পাওয়া এ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। একে 'রেটুন ক্রপ' বলা হয়। তবে ধান গাছ পাঁচবার কেটে দিয়ে ফলন লাভ করার কাজ নিয়ে আর কেউ এ রকম গবেষণা করেছে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে এ গবেষণাটির অভিনবত্ব রয়েছে বলতেই হবে। তা সত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন তো এসেই যায়। এক জমিতে বছর ধরে ধানচাষ কতটা বিজ্ঞানসম্মত হবে। আমাদের তো একই জমিতে তিনটি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চারটি ফসলও জন্মাতে হয়। এর একাধিক যৌক্তিক কারণও রয়েছে। এক, আমাদের ধানশস্য ছাড়াও নানা রকম ফসল ফলাতে হয় খাদ্যের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় খাদ্য গ্রহণ করে আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য। দুই, ফসলের মাঠে একেক ঋতুতে একেক রকম ফসল ফলাতে পারলে বার্ষিক মোট উৎপাদন এবং লাভ অধিক হয়ে থাকে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। তিন, জমিতে মাটির নানা স্তরে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকে। একই জমিতে নানা রকম ফসল ফলানোর মাধ্যমে মাটির নানা স্তরে বিদ্যমান খাদ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। ফলে এসব বিষয় মাথায় নিয়ে ভালোভাবে লাভালাভের বিষয়টি কিন্তু হিসাব করে দেখতে হবে।
পত্রিকা মারফত তার আরও কিছু উদ্ভাবনের কথা জানতে পারলাম। এর আগে ড. চৌধুরী অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বলেও জানিয়েছেন। আবার দু'বার ফসল হয় তেমন 'রাইস টুআইস' রকম ধান জাত উদ্ভাবন করার কথাও তিনি বলেছেন। এবারকার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানতে পারছি, তিনি ২০ বছরে ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। জানতে পেরেছি তার লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টা উদ্ভাবনের কথাও। এসব কেবল উদ্ভাবন করলে তো চলবে না, আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ধান ও ভুট্টার জাতের ছাড়করণও কিন্তু করতে হবে। এসব জাতের কোনোটিই কিন্তু রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়নি। যায়নি এসব এ দেশের কৃষকের কাছেও। এতগুলো উদ্ভাবনের কোনোটিই যদি মাঠ পর্যায়ে আবাদের ছাড়পত্র না পায় তাহলে আমাদের কৃষকের কী লাভ হবে এসব উদ্ভাবন থেকে? আমি মনে করি, তার এখন ধানের নতুন জাত ছাড়করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এসব মাঠে নিয়ে যাওয়ার কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। সেসব প্রক্রিয়া পেরুবার জন্য বেশকিছু নিয়মকানুন মেনেই এগোতে হবে। ড. চৌধুরী এ বিষয়ে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেই পারেন। নিদেনপক্ষে তিনি এসব উদ্ভাবন নিয়ে কথা বলতে চাইলে কিংবা কোনো সেমিনার করতে চাইলে বাংলাদেশ উদ্ভিদ প্রজনন ও কৌলিতত্ত্ব সমিতির মাধ্যমে সে রকম আয়োজন করার ক্ষেত্রে আমি তাকে সহযোগিতা করতে পারি অনায়াসেই।
একজন উদ্ভিদ প্রজননবিদকে ধানের জাত সৃষ্টি এবং তা ছাড়করণের জন্য যে নিয়মবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, তা বেশ সময় ও কষ্টসাপেক্ষ ব্যাপার। দিনশেষে এসব উদ্ভাবন ফসলের মাঠে ঠাঁই করে নিতে না পারলে সব কষ্টই বৃথা হয়। আমি চাই এবার অন্তত তার নতুন জাত সরকারি সনদ পাক এবং তা এ দেশের কৃষকের হাতে পৌঁছে যাক। নইলে উদ্ভাবন থেকে এ দেশের কৃষকের কোনো লাভ হওয়ার সুযোগই সৃষ্টি হবে না। এসব জাতের ভালোমন্দ বিচারের সুযোগও আমরা পাব না, পাবে না আমাদের কৃষককুলও।
ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন