- মতামত
- ডিজিটাল পদ্ধতির বিআরটিসিই পারে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে
রাজধানীতে ডিজিটাল বাস সার্ভিসের রূপরেখা
ডিজিটাল পদ্ধতির বিআরটিসিই পারে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে

২০০৫ সালের ৩১ মার্চ রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি টেলিটক যাত্রা শুরুর এক মাসের মধ্যে দেশের মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাতে ভয়েস কলের মূল্য প্রতি মিনিট ৭ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমে সাড়ে চার টাকা হয়। ছয় মাসের মধ্যে ইনকামিং চার্জ সম্পূর্ণ ফ্রি হয়ে যায়। টেলিটক আসার আগে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটররা ভয়েস কলের দাম না কমানোর জন্য অনেক রকম যুক্তি, অজুহাত দেখায়। কিন্তু টেলিটক কম মূল্যে ভয়েস কল সেবা নিয়ে আসার পর বেসরকারি অপারেটররা আগের যুক্তির জায়গা থেকে সরে এসে নিজেরাই ভয়েস কলের দাম কমায়। কারণ বাজারে প্রতিযোগিতায় পড়তে হয় তাদের। এই প্রতিযোগিতায় টেলিটকের অবস্থান যাই হোক, মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনও ভারসাম্য রক্ষায় বড় ভূমিকা টেলিটকেরই।
আমরা জানি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি পরিবহন করপোরেশন আছে। এটি সরকার পরিচালনা করে। টেলিটকের পথ অনুসরণ করে এই বিআরটিসিকে কি পরিবহন খাতের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি হিসেবে গড়ে তোলা যায় না? রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে এই কোম্পানি যদি গড়ে তোলা হয়, তাহলে অন্তত, রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে তোলা সম্ভব হবে এই বিআরটিসিকে ব্যবহার করেই। তখন যুগের পর যুগ ধরে পরিবহন খাত দখলে রাখা স্বয়ম্ভূ পরিবহন নেতা কিংবা মাফিয়াদের কাছে সরকারে জিম্মি থাকতে হবে না। বিআরটিসিকে দক্ষ ও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সফল একটি সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়।
বিআরটিসিকে সবার আগে আইন করে কোম্পানিতে বদলে দিতে হবে। এরপর বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো বাদ দিয়ে ডিজিটাল ব্যবস্থা নির্ভর একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে করপোরেশনের প্রয়োজনীয় জনবল রেখে এবং অপ্রয়োজনীয় জনবল বাদ দিয়ে নতুন একটি জনবল কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেটি ডিজিটাল সাংগঠনিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার উপযোগী সাংগঠনিক কাঠামো থাকলে কোম্পানির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজটি সহজ হয়ে যাবে। কোম্পানির জন্য একজন অভিজ্ঞ, পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ ও পরিচালকদের নিয়োগ দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এমডি পদে সরকারি ক্যাডার থেকে কর্মকর্তা ধার করে প্রেষণে বসানো যাবে না, কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বোর্ডের চেয়ারম্যানও করা যাবে না। কারণ টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানিগুলো এবং বিমানের ক্ষেত্রে আমলা নির্ভর পরিচালনা পরিষদকে কোম্পানি পরিচালনায় দক্ষতার চেয়ে জটিলতা সৃষ্টি করতেই বেশি দেখা গেছে। এ কারণে এ কোম্পানি আইন এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনেই এমডি ও পরিচালকদের পদে প্রেষণ নিষিদ্ধ থাকতে হবে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ আমলাদের দিয়ে নয়, বরং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে প্রতিষ্ঠিত ও গণ্য-মান্যদের সমন্বয়ে গঠন করা একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে।
ডিজিটাল ব্যবস্থায় প্রথমে এ কোম্পানির জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় এমন বাস সংগ্রহ করতে হবে কিংবা যদি সম্ভব হয় বিদ্যমান বাসগুলোকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। এর রুট ম্যাপিং, রুট অপারশেন সবকিছু হবে ডিজিটাল। একই সঙ্গে একটি অ্যাপ তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে বিআরটিসির প্রতিটি বাস ট্র্যাকিং করা হবে। বিআরটিসির নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তারা যেমন রাস্তায় বাসের প্রতি চোখ রাখতে পারবেন, তেমনি যাত্রীরাও অ্যাপ ব্যবহার করে বাসের অবস্থান এবং বাস যে পথে আসছে সে পথের যানজটের অবস্থা দেখে নিতে পারবেন।
শতভাগ ডিজিটাল টিকেটিং ব্যবস্থা থাকবে। এ জন্য বিআরটিসির একটা ডিজিটাল পেমেন্ট কার্ড থাকবে। যেখানে ব্যাংক কার্ড কিংবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন নগদ, বিকাশ, রকেট থেকে রিচার্জ করা যাবে। এখানে ভাড়ার ব্যবস্থায় দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার সেকেলে ও পুরনো পদ্ধতি বদলে এককালীন ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন একজন যাত্রী কার্ডে তিনশ’ টাকা রিচার্জ করলে তিনি যে দূরত্বেই যান না কেন, ৩০ বার ভ্রমণ করতে পারবেন। এতে যাত্রী খুশি, কারণ তার প্রতি ভ্রমণে গড়ে মাত্র ১০ টাকা খরচ হচ্ছে। আবার একসঙ্গে কয়েক লাখ যাত্রীর নিয়মিত রিচার্জের কারণে কোম্পানির একাউন্টও স্বচ্ছ্বল থাকবে। এই হিসেবেও প্রতিদিন যা আয় হবে তা দিয়ে মাসের সব পরিচালনা ও বেতান-ভার ব্যয় বাদ দিয়েও খুব ভালো লাভ থাকবে। কারণ বাসের ভেতরে টাকা গোনার বিষয় থাকবে না বলে কর্মীদের টু পাইস কামানোর ধান্ধার সুযোগও থাকবে না। ফলে কোম্পানির ভাড়া আদায়ে কোনো সিস্টেম লসও থাকবে না। এটাই হবে বড় লাভ। অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে মুনাফার দিকটি প্রাধান্য পায় না, আমরা টেলিটক, বিটিসিএল, বিমানের ক্ষেত্রে তো তাই দেখছি।
এই ব্যবস্থায় প্রতিটি স্টপেজ থেকে যাত্রীরা বাসে ওঠার সময় কোম্পানির কর্মী যাত্রীদের কার্ড স্ক্যান করে বাসে তুলবেন। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন লোক ঢাকার বাইরে থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে এসে ঢাকায় ঢোকার ক্ষেত্রে কার্ড কোথায় পাবেন? সাধারণত যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বাস ব্যবহার করেন না। তবে যারা দেশের অন্য এলাকা থেকে ঢাকায় আসবেন তাদের জন্য তো বটেই, সব সাধারণ যাত্রীদের কার্ড প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মোবাইল অপারেটর কিংবা এমএসএস সার্ভিসের এজেন্টদের মাধ্যমে বিআরটিসি’র ডিজিটাল পেমেন্ট কার্ড সহজে প্রাপ্তি এবং রিচার্জের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের মোড়ে মোড়ে, অলি-গলিতে মোবাইল ফোন এবং এমএফএস সার্ভিসের এজেন্টরা আছে। অতএব তাদের ব্যবহার করে কার্ডের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করাও কোন কঠিন কাজ নয়। দূরপাল্লার বাস কিংবা ট্রেন থেকে নেমে হাতের কাছেই দোকান থেকে পেমেন্ট কার্ড কিনে নেওয়া যাবে। আর একদম সাধারণ, অশিক্ষিত মানুষ যেমন এ দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে নিজেদের ডিজিটাল ব্যবস্থায় দ্রুত একাত্ম হয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে, তেমনি ডিজিটাল পেমেন্ট কার্ডে অভ্যস্ত হতেও তাদের একবারেই সময় লাগবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে ঢাকার কয়টি রুটে বিআরটিসি’র ডিজিটাল বাস চলবে? যদিও অশুভ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ঢাকায় অকল্পনীয়ভাবে প্রায় আড়াইশ’ রুট অনুমোদন করেছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু বাস্তবে ঢাকার প্রধান রুট দশটির বেশি হওয়ার কারণ নেই। আমি মনে করি বেসরকারি সব বাস সর্ভিস বন্ধ করে পুরো রাজধানীতে শুধুমাত্র বিআরটিসি’র ডিজিটাল বাস সার্ভিস চালানো উচিত। এসি এবং নন এসি দুই ক্যাটাগরির বাস ঢাকার দশটি রুটে চলবে। ২০০১ সালের পর রুট বাণিজ্য শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় প্রধান ১০টি রুটই ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে ২০০৯ সালের পরও এই রুট বাণিজ্য অব্যাহত থেকেছে এবং আরও বিস্তৃত হয়েছে। বিআরটিসির ডিজিটাল বাস ব্যবস্থা এই রুট বিশৃঙ্খলা দূর করবে। ফলে রাস্তায় দুই বাসের মধ্যে ভয়ংকর ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে এবং সড়ক দুর্ঘটনাও একেবারেই কমে যাবে। আর তখন যুগ যুগ ধরে গণপরিবহন দখলে রাখা পরিবহন খাতের স্বয়ম্ভূ নেতারা কথায় কথায় রাজধানী অচল করে সরকার এবং সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পারবেন না। মালিক-শ্রমিক সংগঠনের সামে এই নেতারাই পরিবহন খাততে শিল্প খাতে রূপান্তর করতে দিচ্ছেন না বছরের পর বছর ধরে। তাদের কারণেই গণপরিবহনে আদর্শ মালিক-শ্রমিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বরং গডফাদার-ক্যাডার ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করার মাধ্যমে গণপরিবহনে নৈরাজ্যকেই নিজেদের অবৈধ আয়ের পথ হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। যে কারণে ঢাকায় বার বার উদ্যোগ নিয়েও এক রুট ফ্রানচাইজিং কার্যক্রমই বাস্তবায়ন করা যায়নি। সরকার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণেও কার্যত কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। এই তথাকথিত নেতাদের একচ্ছত্র দখলদারিত্বের কারণে গণপরিবহনের চালক-হেল্পাররাই সবচেয়ে অনিয়মিত, কম বেতন পান এবং চরম মানবেতর জীবন-যাপন করেন। শুধুমাত্র রাজধানীতে বিআরটিসি’র মাধ্যমে ডিজিটাল বাস সার্ভিস চালু করা হলে পরিবহন খাত এই নেতা নামধারী গড়ফাদারদের জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হবে। সরকারও সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে এবং সরকারও সাধুবাদ পাবে।
অবশ্যই বেসরকারি উদ্যোক্তারাও পরিবহন খাতে ব্যবসা করবেন। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যবসা করবেন ঢাকা থেকে দূরপাল্লার রুটে এবং আন্তঃজেলা রুটে। সেখানে তাদের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবসার সুযোগ সরকারই সৃষ্টি করে দেবে। বিগত বছরগুলোতে দখলদার স্বয়ম্ভূ পরিবহন নেতা নামধারীদের দৌরাত্মের কারণে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দূরপাল্লার বাস সার্ভিসে দেশের অনেক ভালো ব্যবসায়ী, বিনিয়োগেকারী বিনিয়োগ তুলে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে বিনিয়োগ করতে চাইলেও সাহস পাননি। তারপরও দূরপাল্লার পরিবহন সার্ভিসেই সত্যিকারের কয়েকজন পরিবহন ব্যবসায়ী এখনও আছেন, যারা এরই মধ্যে নিজেদের দূরপাল্লার রুটের সার্ভিসে অনলাইন টিকেটিংসহ ন্যূনতম হলেও ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করেছেন। দূরপাল্লার রুটে বেসরকারি বাস সার্ভিসের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হলে দেশের অনেক তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোক্তা বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন, ন্যায্য ভাড়ায় অনেক ভালো সেবাও পাবেন যাত্রীরা।
মন্তব্য করুন