কিছুদিন আগে এক আত্মীয়বাড়ি গিয়েছিলাম। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ। বুঝতে পারলাম, কান্না করছেন কোনো এক নারী। আমার মাসিকে জিজ্ঞেস করলাম, পাশের বাড়িতে কাঁদছে কে? কেউ কি অসুস্থ? তিনি উত্তর দিলেন- না। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। তারা প্রায়ই মারামারি করে। জানতে চাইলাম, মারামারি করে কেন? তিনি বললেন, শাওন ঢাকায় চাকরি করত। করোনার কারণে চাকরি চলে যায়। তারপর গ্রামের বাড়ি চলে এসেছে। কয়েক মাস ধরে সংসারে অভাব-অনটন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিন বেলা পেটপুরে খেতে পারে না। মূলত এ নিয়েই ঝগড়া। ঘরেও নারী নিরাপত্তাহীন!

করোনার কারণে কত মানুষ চাকরি হারিয়েছে! ঢাকা শহর ছেড়ে যারা চলে গেছেন, তাদের অনেকেই এখন ভালো নেই। অনেকের আয় কমে গেছে, অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে এসব মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে। নানা সংকটের কারণে আমাদের আশপাশে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। দিন দিন অপরাধও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় বিশ্বব্যাপী। এ দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান সূত্রে ভয়াবহ তথ্য জানা যায়। তাদের পরিসংখ্যান হলো- গত ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ১৭৮ নারী, ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ২৭৬ নারীর ওপর, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জনকে, ধর্ষণের পর লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছেন আটজন, শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে ও অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হয়েছে ২০ নারীর শরীর। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ছিল ২১ হাজার ৭৮৯টি। তা এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। এই হিসাবে মহামারিতে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা কারও কাম্য নয়। নারী নির্যাতনের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বৈষম্যের। সামাজিক বৈষম্যের ছায়া যত বিস্তৃত হচ্ছে, নারী নির্যাতন তত বাড়ছে।

জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এই সময়ে বিশ্বে সহিংসতার শিকার হয়ে আগের তুলনায় পাঁচ গুণ নারী হেলপলাইনে ফোন করেছেন। করোনা সংক্রমণের পর থেকে আমরা সবাই কমবেশি অনলাইননির্ভর হয়ে উঠেছি। বিশেষ করে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোটাই অনলাইননির্ভর এবং হোম অফিস থেকে শুরু করে কেনাকাটা অনলাইননিভর্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি অনলাইনে বা ভার্চুয়াল জগতে সহিংসতা এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। মনে হয়, অনেক ঘরেই অনলাইনে সহিংসতার শিকার হওয়া নারী রয়েছেন। একটি জরিপে জানা যায, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর ৭৯ শতাংশ কখনও কখনও অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী। অনলাইনের সহিংসতার শিকার হয়ে ১৪ শতাংশেরও বেশি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। ডিজিটাল যুগে যেখানে আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে যাব, সেখানে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে অনেকেই। কিছু মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ভালো কিছু গ্রহণ করা বাদ দিয়ে অযথা নিজে সময় নষ্ট করে অন্যের ক্ষতি করছে। তাহলে কি সমাজে এক শ্রেণির মানুষ দিন দিন হিংস্র হয়ে যাচ্ছে? বিবেক-বুদ্ধি কি লোপ পাচ্ছে? নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে। তারা নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান চেয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ করেছেন গত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসেও। তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ জন্য দায়ী আসলে বিবেকহীন অমানবিক মানুষ। অথচ বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ কখনও এমন কাজ করতে পারে না।

মানুষ তার বিবেকবোধ দিয়ে মানবিক মন জাগ্রত করে যতক্ষণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারবে, ততক্ষণ এ সহিংসতা কমবে না। সামাজিকভাবে অপরাধমূলক কাজ থেকে নিজেকে ও অন্যকে বিরত রাখতে হবে। আমাদের পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, মানসিকতা, সংস্কৃতিচর্চা সবকিছুতে পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনসহ পরিবারের সবার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সব অনাচার, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে হবে যূথবদ্ধভাবে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগও নিশ্চিত করা জরুরি। বৈষম্যই বাড়াচ্ছে কদাচার। বৈষম্যের ছায়া সরাতেই হবে। তাহলে শুধু নারী নির্যাতনই নয়, রুদ্ধ হবে অনেক কদাচারের পথ। সব মানুষের যৌথ প্রচেষ্টাতেই নির্যাতনমুক্ত, সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করা যায়। অধিকারের সমতারও বিকল্প নেই। অধিকারের সমতা নিশ্চিত হলে অন্ধকার দূর হবে- এই প্রত্যাশা অমূলক নয়।

গবেষক