
গত মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৯ থেকে ১৪ নভেম্বর ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় সফর চলাকালে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার যে সম্মতিপত্রে সই করেছে, তাতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে আধুনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলোও যুক্ত রয়েছে। ঢাকা-প্যারিস সম্পর্ককে পরের ধাপে উত্তরণে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ব্যবসা, বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়েও কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয়। বাংলাদেশ '৭২-এর ১৭ মার্চ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আবাসিক কূটনৈতিক মিশন চালু করে। বস্তুত, ফ্রান্স ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ধীরে ধীরে বাড়ছে। দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে, এমন দেশের তালিকায় ফ্রান্স পঞ্চম। ফ্রান্স বিমান ও জাহাজের যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে রপ্তানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি আয় আসে ফ্রান্স থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ফ্রান্সের এজেন্সি ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট-এএফডির বৃহত্তম সহায়তা গ্রহণকারী দেশ। বলা বাহুল্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ফ্রান্স সফর গুরুত্বপূর্ণ। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ দেশীয় সক্ষমতা উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেদিক থেকেও দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সবার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রেখে অবাধ, মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অংশগ্রহণমূলক ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। উভয় দেশই রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের তহবিল নিশ্চিত করা এবং মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্স ফ্রান্স যেভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে, সেটি তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, সেটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় রূপান্তরের ওপর জোর দিচ্ছে উভয় দেশ। এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পরবর্তী স্তরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে উভয় নেতা স্বাক্ষরিত অভিপ্রায়পত্র বা লেটার অব ইনটেনশনে কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি স্থানান্তর, প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং প্রযোজনের নিরিখে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা। এর বাইরে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিমানের কর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতা জোরদার করতে ফ্রান্সের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তারা বিমান নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনে সহায়তার যে কথা বলেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশ যে বিমান চালনা এবং বৈমানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে নজর দিচ্ছে, এর মাধ্যমে দেশীয় প্রতিরক্ষা এবং সামরিক উপকরণ আরও উন্নততর করা সহজ হবে। বলা বাহুল্য, ফ্রান্সের সঙ্গে এ চুক্তি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন নিঃসন্দেহে।
আমি মনে করি, ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি আরও নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, বিশ্বে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক গুরুত্ববহ প্রতিরক্ষা চুক্তি নির্দেশ করে- দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ উপেক্ষণীয় নয়। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের এলিসি প্রাসাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। দ্বিতীয়ত, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যের অন্যতম কারণ বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ অঞ্চল ঘিরে আমরা আইপিএস তথা মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল যেমন দেখছি, তেমনি রয়েছে চীনের নেতৃত্বে বিআরআই তথা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। একই সঙ্গে কোয়াড ও এফওআইপি (ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক) রয়েছে। এ অঞলের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং সমৃদ্ধিশালী বাজারও বিশ্ববাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, কেবল ফ্রান্সই নয়, ইউরোপসহ বিশ্বে উল্লেখযোগ্য শক্তিগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ 'ফোর্সেস গোল-২০৩০' কর্মসূচির মাধ্যমে তার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণে উদ্যোগ নিয়েছে, তখন জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের মতো দেশও উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র সরবরাহে আগ্রহী হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময়ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ফরাসি টুইন-ইঞ্জিন মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট বিক্রির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। চতুর্থত, উভয় দেশই চায়, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। ফলে এ চুক্তি যৌথভাবে সন্ত্রাস দমন প্রচেষ্টারও অংশ। বলা বাহুল্য, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের বিস্তার প্রতিরোধে নীতিগত অবস্থান আরও দৃঢ় করেছে।
একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কিংবা কূটনীতির প্রথাসিদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফর বৈদেশিক নীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা খাতের উন্নতি ও সম্প্রসারণ ঘটে- সফরটি সেটিও প্রমাণ করেছে। মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশকে আজ বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেটি এক সময় পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের উপহাসের পাত্র ছিল। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশ কতটা সফল, তা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এমন নানা চুক্তিই প্রমাণ করে। আগেই বলেছি, ফ্রান্স রোহিঙ্গাদের বিষয়টি যে গুরুত্ব দিয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবি উচ্চকিত করা এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনে বিশ্বকে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার এ সুযোগকে বাংলাদেশের কাজে লাগানো উচিত।
ফ্রান্সের চুক্তি বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে কাজে লাগাতে পারে। আমরা জানি, এ অঞ্চল নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। আইপিএস, কোয়াড কিংবা বিআরআই এর প্রমাণ। এ প্রতিযোগিতার মধ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি ও উভয় দেশের বন্ধুত্ব এ অঞ্চলের অন্যান্য শক্তির কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেবে। সুতরাং বলাই যায়, প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফর কেবল দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বকেই জোরদার করবে না বরং তৃতীয় পক্ষের সুবিধালাভেও সহায়ক হবে। ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের সঙ্গে প্রতিরক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিকেও কাজে লাগাতে এ চুক্তি থেকে বাংলাদেশ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশে ফরাসি বিনিয়োগ এখনও তার বৈশ্বিক বিনিয়োগের তুলনায় কম। ফরাসি বিনিয়োগকারীরা যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় সে প্রচেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংযোগ কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। সে জন্য সড়ক, রেল, সমুদ্র, জ্বালানি ও ডিজিটাল সংযোগ ক্ষেত্রে অঞ্চলজুড়ে বড় বিনিয়োগ দরকার। ফ্রান্স এখন বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হলেও ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বৈচিত্র্যময় হওয়া চাই।
ফ্রান্স সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দেশের প্রেসিডেন্ট মাক্রোনের সঙ্গে যেমন বৈঠক করেছেন; তেমনি ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তার আলোচনা হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সে দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফলে এই ফ্রান্স সফরের মাধ্যমে আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়াসহ নানা অর্জন দেখছি। এ অর্জন আরও অর্থবহ করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের বিকল্প নেই।
ড. দেলোয়ার হোসেন :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন