আজ ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালে এই দিনকে জাতিসংঘ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও সুবর্ণ বিজয় উৎসবের দ্বারপ্রান্তে এ বছর দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য 'ইকুয়ালিটি- রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটিস, অ্যাডভান্সিং হিউম্যান রাইটস'। সমতাভিত্তিক সমাজে বৈষম্য কমিয়ে প্রত্যেকের মানবাধিকার সুরক্ষার ওপর এবার জোর দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, সমতার কথা যখন আমরা বলছি, তখন বিশেষত নারীকে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি, এ বিশ্বের কোনো মহৎ কাজই নারীর অবদান ছাড়া পূর্ণতা পায়নি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি নারীরাই প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও তার প্রচার-প্রসার এখনও আশানুরূপ নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে নারীর এই অসামান্য কীর্তিগাথার পরিচিতি দেওয়া ও এসব বিষয় আলোচনায় আসার এখনই সময় বলে মনে করি।
বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাদের দিয়েছিলেন 'বীরাঙ্গনা' উপাধি। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহিনার গবেষণায় উঠে এসেছে এক মূল্যবান তথ্য, 'এক বীরাঙ্গনা বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে সমাজে তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা হিসেবে সম্মানীয় হবেন। তাদের ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ এবং তাদের পিতার নামের জায়গায় ব্যবহার করবেন বঙ্গবন্ধুর নাম।' কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। বর্তমানে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট লাঘবের নিমিত্তে নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার 'মুক্তিযুদ্ধে নারী' নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন, 'দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। ফিরে আসছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস। এই ইতিহাসে নারীরা সঠিক জায়গায় মূল্যায়িত হয়নি।' তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে অংশ নিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় তাদের অনন্য অবদান অদৃশ্য হয়ে আছে।' তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যাপৃত অনুসন্ধানীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।


আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু নারীদের বেদনা ও কষ্ট ছিল অনেক বেশি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের 'মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ' শিরোনামে নিবন্ধটি পাঠে দেখা যায়, তিনিও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের অনেক না জানা অধ্যায়ের জানান দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শাহাদাত বরণ করেছেন এবং সল্ফ্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী এই ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে কতজন পুরুষ, আর কতজন নারী, তার হিসাব কেউ রাখেনি। হয়তো এই হিসাবও রাখা হয়নি, কতজন নারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, কাকন বিবি, গীতা কর, শিরিন বানুসহ বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু যে অগণিত মা-বোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার হিসাব আমরা কি কখনও রেখেছি? এ নিয়ে কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? নিবন্ধটিতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই প্রশ্ন দুটি রেখে তিনি উল্লেখ করেছেন, এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি লজ্জার বিষয়।
বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের চেয়ে অগ্রগামী। বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতাসূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের 'বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতাসূচক-২০২০' শীর্ষক প্রতিবেদনে উলেল্গখ করা হয়েছে, বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ হলো বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে গত ৫০ বছরে শীর্ষস্থানে পুরুষদের তুলনায় নারীরা দীর্ঘমেয়াদে রয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। কিন্তু এখনও মন্ত্রিপরিষদে মাত্র ৮ শতাংশ নারী প্রতিনিধি; আর সংসদে রয়েছে ২০ শতাংশ। যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দি্বধায় বলা যায়, প্রকৃত মর্যাদা বা সম্মানের জায়গায় এখনও অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। কারণ এখনও নারীকে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হতে হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদচিত্র থেকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি নারী ও শিশুদের বিভিন্ন যৌন বিকৃত মানুষ দ্বারা ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার শিকার হতে। ৬ বছরের শিশুর যৌনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করা হয়েছে বীভৎস কায়দায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার তথ্য সংগ্রহ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাসিক পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপেও দেখা যায়, পারিবারিক নিপীড়ন এবং নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষকের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার প্রতিবাদ ও গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এর পরও ধর্ষণের ঘটনা থেমে থাকেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে জাতীয় ইনকোয়ারি কমিটি।
আমি মনে করি, একের পর এক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনার কারণ এখনই চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। নারীর মানবাধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। ধর্ষক যেই হোক না; তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগ কর্তৃক অভিযোগ গ্রহণ সম্পর্কিত হটলাইন সার্ভিসগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও আইনগত সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ট্রমাটাইজড নারীদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন কাউন্সেলিং এবং ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক সম্মান। প্রয়োজন আমাদের মানসিকতা ও চিন্তাধারার পরিবর্তন।
নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ। এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক সচেতনতার পাশাপাশি পারিবারিক সম্প্রীতি নারীর প্রতি সহিংসতারোধ বিষয়ক বার্তা ব্যাপকভাবে প্রচারের পাশাপাশি তথ্যচিত্র, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সর্বোপরি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মানবিকতাকে জাগ্রত করতে হবে।
আমি মনে করি, নারী একজন মানুষ এবং মানুষ হিসেবে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার তার রয়েছে। আমরা যেদিন নারীকে সম্মান দেখাতে পারব, যেদিন নারী-পুরুষ দু'জনেই মানুষ- এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, সেদিনই কার্যত নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়ন কমে আসবে বলে আশা করি।
নাছিমা বেগম :চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন