- মতামত
- আবরার হত্যা মামলার রায় যে বার্তা দিল
মুখোমুখি অবাধ্য সত্য
আবরার হত্যা মামলার রায় যে বার্তা দিল

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড ছিল দেশে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর অন্যতম। এর পর সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা জানি, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে বিপথগামী কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বৈঠক করে আবরারকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলটি ৭৮ কার্যদিবস পর ৮ ডিসেম্বর ২০২১ রায় দেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহের মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে কখনও আর না ঘটে, তার রোধকল্পে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের রায়ে শুভবোধসম্পন্নরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাদের মতো দেশে বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির অন্যতম কারণ। এমনটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। রিসোর্সের দুর্বলতা, পুলিশের চার্জশিট প্রদানে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, সর্বোপরি ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকরের কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দুরূহ ব্যাপার। এ পরিস্থিতিতে যদি আমরা দেখি, তাহলে এই বিচারে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। প্রথমত, খুব দ্রুততার সঙ্গে এ মামলার রায় হয়েছে। আমাদের সমাজের মধ্যে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি রয়েছে, সে জায়গায় তুলনামূলক দ্রুত আবরার হত্যার বিচার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে নিম্ন আদালত ঘিরে সমালোচনা রয়েছে যে, নানা কারণে নিম্ন আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা সেভাবে নেই। সেই জায়গা থেকে নিম্ন আদালত দৃষ্টান্তযোগ্য একটি রায় দিয়েছেন। তৃতীয়ত, ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার যেসব দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই রায়ের মাধ্যমে আবরারের পরিবারের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না। তার পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে, তাও পূরণ করা সম্ভব নয়।
তবে এ কথা সত্য, চূড়ান্ত বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও প্রক্রিয়া রয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে যাবে। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেদিন এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে, সেদিনই আমরা মনে করব, একটি পরিপূর্ণ বিচার হলো। আমরা আশাবাদী, এ প্রক্রিয়াও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। এতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার যে সমালোচনা রয়েছে, তা দূর হবে। তবে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে এবং এমন নৃশংসতা প্রতিরোধের উপায়গুলো কী, তা আমাদের সবার ভাবনার সবচেয়ে বড় উপজীব্য বিষয় হওয়া উচিত। কারণ, মানুষ সামাজিক প্রাণী। মানসিক সমস্যা থাকলে ব্যক্তি অপরাধ করতে পারে। কিন্তু আবরারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিপথগামী কয়েকজন নেতাকর্মী মিলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ পরিস্থিতি আমাদের দেশের রাজনৈতিক চিত্র, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির বিবর্ণ দিকটি স্পষ্ট করে তুলেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি না হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর হল দখলের রাজনীতি একটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সামরিক শাসকরা যখন দেশের ক্ষমতা দখল করেছেন, তারা বিভিন্নভাবে রাজনীতি কলুষিত করেছেন। তবে সামরিক শাসনের আগে যে এভাবে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি, তাও নয়। স্বাধীনতার কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে সেই খুনের দ্রুত বিচার হয়েছিল। পরে যদিও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে সাজাপ্রাপ্ত মূল আসামি শফিউল আলম প্রধানের দণ্ড মওকুফ করা হয়েছিল।
শুধু একজন শিক্ষার্থী কেন, কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। বুয়েটসহ প্রায় প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন সব সময় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কিংবা দেশের সব রাজনৈতিক দল যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এইধরনের হিংসাত্মক রাজনীতি চলতেই থাকবে। আবরার ফাহাদের মতো ঘটনার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আমাদের এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের আমরা পরিপূর্ণ পরিবেশ, সুযোগ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা দিতে পারিনি বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার দায় সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন এড়াতে পারে না। সম্প্রতি কুয়েটের একজন শিক্ষককে কয়েকজন শিক্ষার্থীর লাঞ্ছনায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। তাই এ অভিযোগে ৯ জন শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করেছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একই সংগঠনের দুই গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে সংঘাত।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে গভীরভাবে আমাদের ভাবতে হবে। র্যাগিং কিংবা গণরুমের মতো অপসংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। কেননা, এ অবস্থা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দেখা যায়, কোনো কোনো শিক্ষার্থী নানা ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে। আরও দেখা যায়, কোনো কোনো বড় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা এলাকাভিত্তিক সমস্যা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনের অসহায়ত্বের কারণে অনেক শিক্ষার্থী এ ধরনের কাজ করছে। এখন সময় এসেছে এসব বিষয়ের দিকে গভীর দৃষ্টি দেওয়ার। আমাদের সন্তানরা যেন ভালো থাকে; উন্নত পরিবেশের মধ্যে তারা যেন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে গড়ে উঠতে পারে- এ শপথ নিতে হবে। আবরার হত্যা মামলার রায় সরাসরি আমাদের নৈতিকতা ও মানসিক জায়গার উন্নয়নে সহায়তা করবে। এ ধরনের মামলার দ্রুত বিচার যাতে সম্পন্ন হয়, সেদিকে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবার গভীর মনোযোগ জরুরি।
শুধু বুয়েট নয়, এর বাইরেও যেসব প্রতিষ্ঠানে এমন অরাজকতা চলছে, তা বন্ধ করতে রাষ্ট্র, সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও প্রশাসনে যারা রয়েছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়া উচিত। হয়তো এক দিনেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন করা গেলে আবরারের মতো ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব। রাজনীতি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে- কোন রাজনীতি? অবশ্যই সুস্থ বিকাশমান রাজনীতি জরুরি, যা দেশ-জাতির কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে ভবিষ্যতের পথ মসৃণ করবে।
আমাদের ছাত্র রাজনীতির অতীত নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। স্বাধীনতার আগে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনসহ নানা ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জাতীয় পর্যায়েও এর ইতিবাচক কিংবা কল্যাণকর প্রভাব দৃশ্যমান। সেই ঐতিহ্য কীভাবে হারিয়ে গেল, এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণক্রমে তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ রাজনীতিসংশ্নিষ্ট সবাইকেই নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, ছাত্র রাজনীতি এখন যেন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি যে ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্র ঘোষিত মূলনীতি, সেই সংগঠন ছাত্রলীগে বিপথগামীদের ঠাঁই হতে পারে না। কলুষিত রাজনীতির নিরসন ঘটানোর দায় রাজনীতিকদেরই।
ড. জিয়া রহমান :সমাজবিজ্ঞানী; অধ্যাপক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের রায়ে শুভবোধসম্পন্নরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাদের মতো দেশে বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির অন্যতম কারণ। এমনটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। রিসোর্সের দুর্বলতা, পুলিশের চার্জশিট প্রদানে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, সর্বোপরি ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকরের কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দুরূহ ব্যাপার। এ পরিস্থিতিতে যদি আমরা দেখি, তাহলে এই বিচারে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। প্রথমত, খুব দ্রুততার সঙ্গে এ মামলার রায় হয়েছে। আমাদের সমাজের মধ্যে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি রয়েছে, সে জায়গায় তুলনামূলক দ্রুত আবরার হত্যার বিচার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে নিম্ন আদালত ঘিরে সমালোচনা রয়েছে যে, নানা কারণে নিম্ন আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা সেভাবে নেই। সেই জায়গা থেকে নিম্ন আদালত দৃষ্টান্তযোগ্য একটি রায় দিয়েছেন। তৃতীয়ত, ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার যেসব দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই রায়ের মাধ্যমে আবরারের পরিবারের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না। তার পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে, তাও পূরণ করা সম্ভব নয়।
তবে এ কথা সত্য, চূড়ান্ত বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও প্রক্রিয়া রয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে যাবে। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেদিন এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে, সেদিনই আমরা মনে করব, একটি পরিপূর্ণ বিচার হলো। আমরা আশাবাদী, এ প্রক্রিয়াও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। এতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার যে সমালোচনা রয়েছে, তা দূর হবে। তবে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে এবং এমন নৃশংসতা প্রতিরোধের উপায়গুলো কী, তা আমাদের সবার ভাবনার সবচেয়ে বড় উপজীব্য বিষয় হওয়া উচিত। কারণ, মানুষ সামাজিক প্রাণী। মানসিক সমস্যা থাকলে ব্যক্তি অপরাধ করতে পারে। কিন্তু আবরারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিপথগামী কয়েকজন নেতাকর্মী মিলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ পরিস্থিতি আমাদের দেশের রাজনৈতিক চিত্র, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির বিবর্ণ দিকটি স্পষ্ট করে তুলেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি না হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর হল দখলের রাজনীতি একটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সামরিক শাসকরা যখন দেশের ক্ষমতা দখল করেছেন, তারা বিভিন্নভাবে রাজনীতি কলুষিত করেছেন। তবে সামরিক শাসনের আগে যে এভাবে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি, তাও নয়। স্বাধীনতার কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে সেই খুনের দ্রুত বিচার হয়েছিল। পরে যদিও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে সাজাপ্রাপ্ত মূল আসামি শফিউল আলম প্রধানের দণ্ড মওকুফ করা হয়েছিল।
শুধু একজন শিক্ষার্থী কেন, কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। বুয়েটসহ প্রায় প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন সব সময় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কিংবা দেশের সব রাজনৈতিক দল যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এইধরনের হিংসাত্মক রাজনীতি চলতেই থাকবে। আবরার ফাহাদের মতো ঘটনার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আমাদের এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের আমরা পরিপূর্ণ পরিবেশ, সুযোগ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা দিতে পারিনি বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার দায় সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন এড়াতে পারে না। সম্প্রতি কুয়েটের একজন শিক্ষককে কয়েকজন শিক্ষার্থীর লাঞ্ছনায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। তাই এ অভিযোগে ৯ জন শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করেছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একই সংগঠনের দুই গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে সংঘাত।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে গভীরভাবে আমাদের ভাবতে হবে। র্যাগিং কিংবা গণরুমের মতো অপসংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। কেননা, এ অবস্থা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দেখা যায়, কোনো কোনো শিক্ষার্থী নানা ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে। আরও দেখা যায়, কোনো কোনো বড় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা এলাকাভিত্তিক সমস্যা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনের অসহায়ত্বের কারণে অনেক শিক্ষার্থী এ ধরনের কাজ করছে। এখন সময় এসেছে এসব বিষয়ের দিকে গভীর দৃষ্টি দেওয়ার। আমাদের সন্তানরা যেন ভালো থাকে; উন্নত পরিবেশের মধ্যে তারা যেন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে গড়ে উঠতে পারে- এ শপথ নিতে হবে। আবরার হত্যা মামলার রায় সরাসরি আমাদের নৈতিকতা ও মানসিক জায়গার উন্নয়নে সহায়তা করবে। এ ধরনের মামলার দ্রুত বিচার যাতে সম্পন্ন হয়, সেদিকে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবার গভীর মনোযোগ জরুরি।
শুধু বুয়েট নয়, এর বাইরেও যেসব প্রতিষ্ঠানে এমন অরাজকতা চলছে, তা বন্ধ করতে রাষ্ট্র, সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও প্রশাসনে যারা রয়েছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়া উচিত। হয়তো এক দিনেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন করা গেলে আবরারের মতো ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব। রাজনীতি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে- কোন রাজনীতি? অবশ্যই সুস্থ বিকাশমান রাজনীতি জরুরি, যা দেশ-জাতির কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে ভবিষ্যতের পথ মসৃণ করবে।
আমাদের ছাত্র রাজনীতির অতীত নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। স্বাধীনতার আগে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনসহ নানা ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জাতীয় পর্যায়েও এর ইতিবাচক কিংবা কল্যাণকর প্রভাব দৃশ্যমান। সেই ঐতিহ্য কীভাবে হারিয়ে গেল, এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণক্রমে তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ রাজনীতিসংশ্নিষ্ট সবাইকেই নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, ছাত্র রাজনীতি এখন যেন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি যে ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্র ঘোষিত মূলনীতি, সেই সংগঠন ছাত্রলীগে বিপথগামীদের ঠাঁই হতে পারে না। কলুষিত রাজনীতির নিরসন ঘটানোর দায় রাজনীতিকদেরই।
ড. জিয়া রহমান :সমাজবিজ্ঞানী; অধ্যাপক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন