বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ২০ শিক্ষার্থীর মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন দণ্ড প্রদান করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার সমকালসহ প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই আলোচিত এই হত্যা মামলার রায়ের খবরের পাশাপাশি উপশিরোনামে আরও কিছু খবর ও পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। আমরা জানি, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারকে শিবির কর্মী সন্দেহে ছাত্রলীগের কিছু বিপথগামী নেতাকর্মী নৃশংসতা-পৈশাচিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে হত্যা করে ক্যাম্পাসেই। এই হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর অন্যতম। বুয়েটের মতো দেশের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম উচ্চ বিদ্যাপীঠে যারা পড়াশোনা করেন, তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে আমাদের রাজনীতিতে যে পচন ধরেছে, এর বাইরে থাকেনি ছাত্র রাজনীতিও। এরই ফের নগ্ন প্রকাশ ঘটে আবরার হত্যার মধ্য দিয়ে। জাতীয় রাজনীতির ক্রমাগত নিম্নগামিতা কীভাবে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অনেককেই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গ্রাসে ফেলেছে; বুয়েটের মর্মন্তুদ এ ঘটনাটি এরই খণ্ডিত দৃষ্টান্ত মাত্র। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গেস্টরুমে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বৈঠক করে তাদের সতীর্থকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সংঘটিত করল- সংবাদমাধ্যমে এ তথ্য উঠে এসেছিল! ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এই মামলার রায়ে নিজস্ব যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা যথার্থ।
আমরা জানি, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এই মামলাটি ৭৮ কার্যদিবস শুনানি শেষে, সব ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে আদালত রায় দিয়েছেন। আমরা আশা করি, এই রায় নৃশংসতা রোধে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বিপথগামীদের সামনে। একই সঙ্গে এও প্রত্যাশা, মামলাটির পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার সব ধাপও দ্রুত সম্পন্ন হবে। শুভবোধসম্পন্নরা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও অপরাজনীতির চর্চাকারী কিংবা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে যাদের ভূমিকা রয়েছে তারা কতটা তা উপলব্ধি করতে পারছেন? দেশের শিক্ষাঙ্গন বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বিগত পাঁচ দশকে বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে; অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। অথচ আমাদের ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত সচেতন কার না জানা! আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যে সহিংসতার কারণে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেন না ও এতজন মেধাবী যূথবদ্ধভাবে বিপথে পা রাখল, এর দায় তো কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। শিক্ষাঙ্গন-সমাজে যেভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে শুধু আমাদের মানবসম্পদ তৈরির পথই রুদ্ধ হচ্ছে না; রাষ্ট্রেরও ক্ষতির চিত্র স্ম্ফীত হচ্ছে। আমরা মনে করি, এই ক্ষতি অপূরণীয়।
অভিযোগ আছে, সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের যে শিক্ষকের প্রাণহানি ঘটেছে, এর পেছনের কারণও ছাত্রলীগের কিছু বিপথগামী নেতাকর্মীর লাঞ্ছনা। সোমবার সমকালে 'বেপরোয়া ছাত্রলীগ ফের আলোচনায়' শিরোনামে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে প্রতীয়মান, কী ভয়ংকর পঙ্কিলতায় ডুবে যাচ্ছে ছাত্রলীগ! আমাদের স্মরণে আছে, আওয়ামী লীগপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে অনেকবার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আমরা দেখছি, তার কঠোর বার্তাও তারা আমলে নিচ্ছে না! এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলতে পারে না। আবরার হত্যা মামলার রায় সমাজের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বটে, কিন্তু রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের গণ্ডিমুক্ত করতে মুখ্যত ভূমিকা পালন করতে হবে রাজনীতিকদেরই।
আমরা বিজয়ের সুর্বণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। অনাচার-বৈষম্য-শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতি রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল রক্তগঙ্গা পেরিয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার-প্রত্যয় ব্যক্ত করে। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে চাই- হীনস্বার্থবাদিতা রাজনীতির অঙ্গভূষণ হয়ে থাকতে পারে না। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনসহ সব ক্ষেত্র থেকে সন্ত্রাসের ছায়া সরাতেই হবে। আমরা আশা করব, আবরারের মতো যাতে আর কারও জীবন এমন পৈশাচিকতার বলি না হয়, তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রশক্তি সক্ষমতার পরিচয় দেবে।