
'এই এলাকায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে আপন ভাইবোনের মতো বসবাস করে আসছি। জীবনের সুখ-দুঃখ আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছি। কিন্তু চোখের পলকে কী করে সেই চিরচেনা মানুষেরা অচেনা হয়ে গেল!' লামা বাজার, বান্দরবানের দোকানি মধুকান্তি দাস বিলাপ করছিলেন এমনি করে। ১৪ অক্টোবর লামা বাজারে যে ৩০টি হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ভাঙচুর ও লুট করা হয়, এর মধ্যে মধুর দোকানটিও ছিল।
অথচ উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বাংলাভাষী সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সমাজকর্মী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ দেশের জন্মলগ্নে, ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, 'এই অঞ্চল যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানদের স্মারকলিপি হয়ে আছে, প্রার্থনা করি তেমনই এ যেন নতুন রাষ্ট্রের জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের মিলনভূমি হয়। আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।' ৪০-এর দশকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উপলব্ধ চেতনার 'বাঙালি জাতিসত্তা'কে পরবর্তী যুগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অনেক বড় কৃতিত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। দুঃখজনক হলেও সত্য, সময়ের হাত ধরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উল্লিখিত এ অঞ্চল আর বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনভূমি হিসেবে বহাল নেই। স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে, গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে সুযোগ সন্ধানী সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ধার্মিকতা আর ধর্মান্ধতার ভেতর যে বিশাল ফারাক বা দূরত্ব, তা সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে আমরা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশে বিভ্রান্ত হতে পারি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধার্মিক বা ধর্মভীরু। সে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন।
সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বীজ কখন, কীভাবে এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় রোপিত হয়েছিল, সে ইতিহাস না জানলে আমরা কখনোই এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবো না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ও কিন্তু এ অঞ্চলের বাঙালির ভেতর এক ধরনের স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিল। তখন এতদঞ্চলে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সামাজিক নেতৃত্ব ছিল রক্ষণশীল হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। তাদের ভেতর মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল প্রবল। যে কারণে এ অঞ্চলের মুসলমান সমাজের বৃহত্তর অংশ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। সে সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে রক্ষণশীল হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, 'তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনো দিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।' অন্যদিকে, স্বাধীনতাউত্তর সত্তরের দশকে বাঙালির মানসচেতনায় যে স্বদেশপ্রেমের পরিস্ম্ফুরণ ঘটে, তা ছিল এক সামগ্রিক অনুভূতি। এই দেশপ্রেম এখানকার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে জাতি, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সমানভাবে উজ্জীবিত করে গোষ্ঠীবদ্ধ করে।
অধিকার তার প্রতিবেদনে বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৯ সালের ভেতর ১২ জন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে; ১৫৩৬ জন আহত হয়েছে, ১০১৩টি সম্পত্তি ও ৩৯০টি মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম মতাবলম্বী মানুষই বেশি করে এই ধর্মান্ধতার শিকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের প্রতিবেদনে বলছে, জানুয়ারি ২০১৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ৩৭১০ বার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে। ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছে; আহত হয়েছে ৮৬২ জন। সবচেয়ে পীড়াদায়ক বিষয় হলো, ১৯৭১ সালে দেশের ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ ছিল হিন্দ। তারা দেশত্যাগের অব্যবহিত ধারায় ২০১১ সালে এসে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান নিশ্চিত করে, সামগ্রিকভাবে আমরা আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শান্তি ও নিরাপত্তায় বসবাসের সুযোগ করে দিতে পারিনি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমেই এ দেশের জন্ম হয়েছিল- এ বিষয়ে নিশ্চয় কারও দ্বিমত নেই। লাখো প্রাণ হারানোর যে মহান ত্যাগ তা আমাদের অর্জনকে মহিমান্বিত করেছে, যা কোনো অবস্থাতেই ভুলে যাওয়ার নয়।
আরও কিছুটা পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪০-এর দশকে তরুণ মুসলিম বাঙালিরা 'মুসলিম' ও 'বাঙালি' পরিচয়কে সঙ্গে নিয়েই তৈরি করেছিলেন একটি পৃথক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। 'বাঙালি মুসলমান' বলে একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে। এই সমাজের পরিচয় কিন্তু শূন্য থেকে এক দিনে তৈরি হয়নি। ১৯২০-৩০ সময়কালে কর্মতৎপর একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো প্রজ্ঞাবান বাঙালি মুসলিম নেতারা পরবর্তী সময়ে এমন সরকার, এমন সমাজ তৈরির কথা বলতে শুরু করেছিলেন, যেখানে মুসলমানদের কেউ নীচু চোখে দেখবে না, মুসলিম সংস্কৃতিকে হেয় করা হবে না। যেখানে মুসলিম যুবকরা নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে সামাজিক কাজকর্মে নেতৃত্ব দিতে পারবে। অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা এই বাঙালি মুসলমানদের চেতনার গভীরে ছিল প্রোথিত। আর এর একজন উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে ঘটে যাওয়া বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলবল দিনরাত লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। কোনোদিন রাতে বাড়ি ফিরেছেন, কোনোদিন পার্টি অফিসেই ঘুমিয়ে রাত কাটিয়েছেন। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর, পাড়া-মহল্লায় তারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার বাসায় খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছে দিয়েছেন। এ সময় বাঙালি মুসলিম নেতারা বাংলার সাধারণ অভাবী দরিদ্র কৃষক, যুবক ও ছাত্রদের অনেক কাছে চলে আসেন, যাদের কথা সেই প্রয়োজনের সময় বাঙালি হিন্দু নেতারা মনে রাখেননি। সে সময় এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালি হিন্দু নেতৃত্বের দূরত্ব হয়ে ওঠে দৃশ্যমান ও অনস্বীকার্য। এখানে গোষ্ঠী বিভেদ বা ধর্ম বিভেদের যে সংবেদনশীল বিষয় সামনে চলে আসে, আমরা সেটিকে কখনোই পরিস্কার সততার সঙ্গে, পক্ষপাতহীনভাবে দেখার চেষ্টা করিনি। উচ্চ বর্ণের হিন্দু মধ্যবিত্তরা দেশভাগের আগে এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের যেভাবে হেয় করেছেন, অসম্মান করেছেন; তারা সমাজ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী হলেও সংখ্যায় অনেক কম ছিলেন। তারা দরিদ্র অব্রাহ্মণ হিন্দু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও একই ব্যবহার করেছেন। দেশভাগের পর শিক্ষিত প্রগতিশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা সে বিষয়টি বুঝতে এবং অনুভব করতে পারেন এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একই ধরনের অন্যায়-অবিচার করা থেকে বিরত থাকেন।
আমাদের পরিস্কারভাবে মনে রাখা দরকার, সাধারণ মানুষের অসম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জীবনের সময় ও বিরাজমান সামাজিক অসম্প্রদায়িক পরিবেশ-পরিস্থিতির সময়ও কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিশ্চিহ্ন বা বিলীন হয়ে যায় না। ওরা নিজেদের গুটিয়ে রাখে সাবধানে; ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে থাকে সুযোগের। সংখ্যালঘুদের বিষয়-সম্পদ তাদের অনৈতিক লিপ্সাকে জাগিয়ে রাখে। অন্যদিকে, অপরাজনীতির বাহকরা সময়ে-অসময়ে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে।
কুমিল্লায় ঘটে যাওয়া ঘটনা কিন্তু সমাজে লুকিয়ে থাকা এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সুযোগ সন্ধানী পরিকল্পিত অপতৎপরতা। এই অপতৎপরতা আমাদের সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দীনতাকে অনাবৃত করে দিয়েছে। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের দেরি হয়ে যাওয়ায় দেশের আরও কিছু জায়গায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গেছে।
অন্যদিকে, প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার গত সাত বছরে সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, কখনও প্রকাশ্যে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২০ সালে রাজধানী দিল্লিতে ঘটে যাওয়া দাঙ্গায় ৫৩ জনের মৃত্যু ঘটে, যাদের ভেতর বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। বিরোধীদলীয় কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য ও সাবেক কূটনীতিক শশি থারুর ২০১৫ সালে সংসদে তার এক বন্ধুর মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, 'বিজেপি শাসিত ভারতে মুসলমান না হয়ে একটি গরু হিসেবে বসবাস করা অধিকতর নিরাপদ।' আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের এই বৃহৎ প্রতিবেশীর বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে পড়ার শঙ্কা সব সময় প্রবলভাবে থেকে যায়। সে বিষয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমানভাবে সাবধান থাকতে হবে।
একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, এ দেশে ধর্মান্ধ অপশক্তি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে যেসব সংখ্যালঘু মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, যেসব বাড়িতে আগুন দিয়েছে তারা সবাই অসহায় হতদরিদ্র নিরীহ সাধারণ মানুষ। এদের তারা বিনা বাধায় শিকারে পরিণত করেছে। সরকারকে সবার আগে এদের নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সহাবস্থানের সংস্কৃতি। সমাজ-নেতৃত্ব সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবে। সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন কঠোর অবস্থান নেবে। কেন বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সুযোগ পাচ্ছে? সে বিষয়গুলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে বুদ্ধি-বিবেচনা ও উপলব্ধিতে এনে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চিন্তাশীল মানুষ সমাজকে সংঘবদ্ধ করে রাষ্ট্রের হাতকে শক্তিশালী করবে। প্রয়োজনে সমাজে সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।
এ দেশের মাটিতে পরাজিত হোক সব সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তা চিরকালের জন্য।
শাকিব লোহানী :কবি ও লেখক
মন্তব্য করুন