ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বের সময় যখন এডওয়ার্ড জিমস করবেট রেললাইন বসানো এবং স্টেশন তৈরির কাজে সংযুক্ত হয়েছিলেন, তখনও কিছু স্টেশনে 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' নামে একটা বিভাগ ছিল। সেখানে রেলের যাত্রীদের হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র জনসাধারণ জমা দিয়ে যেতেন এবং যার জিনিস তিনি এসে খোঁজ করলে ওই যাত্রীকে তার ফেলে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া জিনিসটি ফেরত দেওয়া হতো। এডওয়ার্ড জিমস করবেট দাপ্তরিক কাজের চেয়ে তার বাঘ শিকারের গল্প লিখে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন। তার 'ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন' গ্রন্থে যে বাঘটির হাতে প্রায় ৪৩৬ জন মারা গিয়েছিল, সেই বাঘ শিকারের গল্পটা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। সঙ্গে জিমস করবেটও হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত। ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই যে শিশুটির জন্ম, এই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, বিজয়ের মাসে তার কথা কেন মনে পড়ল! আসলে তার কথা নয়, মনে পড়ল তার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' বিভাগের কথা। হারিয়ে যাওয়া জিনিসটি ফেরত পাওয়ার একটি সুযোগের কথা। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু হারিয়ে গেলে তা আর সহজে পাওয়া যায় না।
এই যেমন ধরুন সমাজ থেকে ক্লাসিক্যাল গান বা উচ্চাঙ্গসংগীত হারিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে এই উচ্চাঙ্গসংগীত কোথায় খুঁজব? আমাদের সমাজে যদি একটা 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' বিভাগ থাকত, সেখানে খুঁজতে যেতাম। সেদিন বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবীর (রনবী) জন্মদিন উপলক্ষে স্থপতি পলাশ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখতে গেলাম। প্রামাণ্যচিত্রে রনবী ভাইয়ের বক্তব্য শুনে চমকে উঠলাম। দর্শক বাংলার বাঘা বাঘা ব্যক্তি যেন। সবাই যে যার কর্মক্ষেত্রে সফল দিকপাল। কার নাম বলব? শিল্পী নিসার, শিল্পী জামাল, শিল্পী শিশির, শিল্পী রনবী, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছেলে মিতু, শিল্পী জাহাঙ্গীরসহ অনেকে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী তার বক্তব্যে বলছেন, 'এক সময় কার্টুন টোকাই খুব পপুলার হলো। তখন অনেক কার্টুন এঁকেছি। নেশার মতো কার্টুন আঁকতাম, এখন আর কার্টুন আঁকি না- কে কী মনে করবে।'
বিখ্যাত এ কার্টুনিস্টের এ বক্তব্য শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি তিনি আর কার্টুন আঁকবেন না! তার মতো বিখ্যাত কার্টুনিস্ট এভাবে সরে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম নিরুৎসাহিত হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই মানুষটি ১৯৬৪ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৩-৭৬ সালে গ্রিসের এথেন্স স্কুল অব আর্টস থেকে ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ডিন হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। চিত্রকলায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার বার্লিনে ১৯৯০, একুশে পদক ১৯৯১, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮৯, কিশোর উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এমনি এক প্রতিভাবান শিল্পী কার্টুন আঁকা বন্ধ করে দেবেন? এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বুঝি? তাহলে কি উচ্চাঙ্গসংগীতের মতো কার্টুনও হারিয়ে যাবে! রনবীর মতো স্বনামধন্য শিল্পীরাও কার্টুন আঁকা থেকে বিরত থাকবেন! রনবী ভাইয়ের বয়স ৭৮ হতে চলল। তিনি আর কতদিন সবল থেকে কাজ করবেন! আমাদের প্রত্যাশা, সমাজ তাকে আরও কাজ করার সুযোগ করে দেবে। তা না করে তাকে পিছু টানছে! অনেক সময় অনেক কার্টুন ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাই বলে কার্টুন আঁকা বন্ধ করবেন? জানি না- কেন চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের মতো কার্টুন সেন্সর বোর্ড করা হচ্ছে না?
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সময় ১৯৭৫ সালে ভারতের মতো পৃথিবীর বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশেও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে কার্টুন সেন্সর হতো। লক্ষ্মণের মতো কার্টুনিস্টরা নির্দি্বধায় কার্টুন এঁকেছেন। ফলে সমাজে কার্টুনের কারণে বিশৃঙ্খলা হওয়ার সুযোগ থাকত না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখনই যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে অচিরেই দেখা যাবে উচ্চাঙ্গসংগীতের যেমন গায়ক নেই, তেমনি বাংলাদেশে কোনো কার্টুনিস্টও নেই। তখন কার্টুনকেও 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' বিভাগে খুঁজতে যেতে হবে!
জাঁ-নেসার ওসমান :চিত্রনির্মাতা ও রম্য লেখক