স্থানীয় সরকার কাঠামোর ইউনিয়ন পরিষদ ও কয়েকটি পৌর নির্বাচন সহিংস হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নির্বাচন এবং নির্বাচনপূর্ব ও পরবর্তী সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা অর্ধশতের ওপরে। স্থানীয় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সরকার কয়েক বছর আগে দলীয় প্রতীকে নিয়ে এসেছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে এর ওপর রাজনৈতিক প্রলেপ পড়েছে। শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় ছিনিয়ে আনার জন্য মরিয়া। নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীই জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু শাসক দলের প্রার্থীরা সরকারে থাকার বাড়তি সুযোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে বিগত ৫০ বছরে যারা ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের সবাই এমনটা ভেবেছে এবং করেছে।
স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। তাদের দলের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে অংশ নিলেও সরকারি দলের প্রার্থীদের সঙ্গে মূলত লড়াই হচ্ছে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপি অনুসারী প্রার্থী আছেন যারা, তাদের ভিতও কম শক্ত নয়।
সরকারি দলের নির্বাচনী ফলাফল এ রকম- প্রথম দফা নির্বাচনে তাদের জয়ের হার ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় দফায় ৫৯ শতাংশ। তৃতীয় দফায় আরও কম ৫৪ শতাংশ। প্রথম দফায় ১৩১ এবং দ্বিতীয় দফায় ১৮১টি ইউনিয়ন পরিষদে মূল প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় তারা আসতেই পারেনি। সহিংসতায় প্রথম দফা নির্বাচনে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের; দ্বিতীয় দফায় বেড়ে ৩০ জন; তৃতীয় দফায় ২৩ জন; যার মধ্যে একজন বিজিবি সদস্য রয়েছেন।
সরকারি দলের এমন ফলাফলের কারণ তাদের দলের ভেতর পর্যালোচনা হবে। কিন্তু আমরা এই নির্বাচনে অতীতের এক সময়ের চিত্র দেখতে পাচ্ছি, যা ছিল জেনারেল এরশাদের আমলের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। এরশাদ তার সময়ের সব নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিলেন। অর্থ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল। কেন্দ্র দখল, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ছিল নির্বাচনের অংশ। তিনি রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। ফলে সেই ধারায় স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।
বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। সমাজে নির্বাচন নিয়ে নানারকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ রয়েছে। নির্বাচনী কাঠামো ভেঙে পড়ছে বলে অনেকে মনে করছেন। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার ফলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে, তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করতে পারবে- গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য তো এমন হবে এবং তা-ই স্বাভাবিক। জনঅধিকার কোনো নেতিবাচকতা দ্বারা বিঘ্নিত হলে জনগণ সে দলকে সমর্থন করতে চায় না। তা সে সরকার যত ভালো কাজই করুক। এটিই বাস্তবতা। এক দশকের ব্যবধানে উন্নয়ন হয়েছে অনেক, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু এ দিয়ে জনসমর্থন অর্জন এবং সংরক্ষণ, ক্ষমতাসীন কারও পক্ষেই ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
করোনা-পরবর্তী সময়ের অর্থনীতি সামাল দিতে গিয়ে সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকার পরিবহন মালিক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ঋণদানকারী এনজিওকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। পরিবহন খাত নিয়ে মানুষের ক্ষোভ অনেক দিনের। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, সেটি মূলত মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। করোনা-পরবর্তী সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনগণকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং গৃহঋণের কিস্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংক ও গ্রহীতা আন্তঃসম্পর্কের সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। অন্যদিকে গরিব মানুষ সাপ্তাহিক কিস্তিতে এনজিও থেকে যে সীমিত ঋণ নিয়েছে, তাতেও কিছু এনজিও এমন চাপ দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলে সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ অনেক বেশি।
১৯৯০ সালের আন্দোলন মূলত ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল। তার পর বিগত তিন দশকে বিএনপি, আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে বিঘ্নিত করেছে। যখন যারা ক্ষমতায় গেছেন তারা সেভাবেই তাদের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পথ রচনা করতে চেয়েছেন। আমরা দেখেছি, শাসক মহলকে ঘিরে চারদিকেই কেমন করে যেন কদর্যতার চিহ্নযুক্ত চরিত্র সৃষ্টি হয়ে যায়। জনগণের দুঃখকষ্টের কথা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। সরকারের উদ্যোগগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভোট ও ভাতের সংগ্রামের আন্দোলন করেছেন। যদি তার শাসনামলেই ভোটের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়; যদি তার শাসনামলেই গরিব মানুষ খাদ্য গ্রহণে রেশনিং করতে বাধ্য হয়, তাহলে সেটি সরকারের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
রুস্তম আলী খোকন :সাবেক ছাত্রনেতা