অনেকটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ হয়ে যাবে, তবুও বলি। রাবেয়া খাতুন আমার লেখক জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা। নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি একজন লেখকের দায়বদ্ধতার সীমারেখা তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন। লেখাকে তিনি উপাসনা ভাবতেন। তাই তার লেখার টেবিল, লেখার কাগজ, লেখার কলম সবকিছুই ছিল আলাদা। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাসা বদল হয়েছে। কিন্তু লেখার টেবিল বদল হয়নি। আমার সাংবাদিকতা জীবনে অসংখ্যবার রাবেয়া খাতুনের মুখোমুখি হয়েছি। সাক্ষাৎকার নিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। তার কাছেই শিখেছি কীভাবে সময়কে গুরুত্ব দিতে হয়, সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। প্রথম সাক্ষাৎকারের স্মৃতি মনে পড়েছে। ইত্তেফাক ছেড়ে আনন্দ আলোতে যুক্ত হয়েছি। সিদ্ধান্ত হলো, রাবেয়া খাতুনের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়েই উপস্থিত হলাম এবং রাবেয়া খাতুনের মুখোমুখি বসার সুযোগ পেলাম। এই প্রথম প্রিয় লেখক রাবেয়া খাতুনকে সামনে থেকে দেখছি। আমার স্কুলশিক্ষক পিতা এই মহান লেখকের গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। আমার মায়ের বালিশের তলায় রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস দেখতাম। রাত জেগে রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস পড়তেন মা। তাদের মুখেই আমি প্রথম লেখক রাবেয়া খাতুনের নাম শুনি। স্কুলজীবনেই রাবেয়া খাতুনের লেখার ভক্ত হয়ে যাই আমি। স্বপ্ন দেখতাম, কোনোদিন যদি ঢাকায় আসার সুযোগ পাই তাহলে প্রথমে রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু এই সুযোগটা এভাবে হয়ে যাবে, কখনোই ভাবিনি।

বসে আছি প্রিয় লেখকের মুখোমুখি। তিনি হাসিমুখে বললেন, মিষ্টি খাও। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি তার দিকে। কী মমতামাখা কণ্ঠ! যেন মায়ের সামনে বসে আছি। সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হলো। প্রথম দিনেই বুঝলাম, লেখক হওয়া অত সহজ নয়। লেখক হতে গেলে অনেক কিছু জানতে হয়, পড়তে হয়। একজন লেখকের মূল শক্তি হলো তার শব্দের সমৃদ্ধ ভান্ডার। সাক্ষাৎকারে অসংখ্য শব্দের মালা গাঁথলেন রাবেয়া খাতুন। আমি অভিভূত। সাক্ষাৎকার শেষে আমার লেখালেখির খোঁজ নিলেন। বললেন, লেখালেখিও এক ধরনের উপাসনা। প্রতিদিন এক পাতা হলেও লিখবে। লেখার টেবিল আর কলমকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।

তার পর থেকে কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, আমাদের প্রিয় খালাম্মা আমার কাছে মা হয়ে উঠলেন। ফোন করলেই প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন, কী লিখছ? দেখা হলে কাছে ডেকে বলতেন- তোমার লেখার খবর কী? ভালো আছ? একটা সময় আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তার মুখের কথা শোনার জন্য হঠাৎ হঠাৎ ফোন দিতাম। এখনও ঘোর কাটেনি আমার। রাবেয়া খাতুন বেঁচে নেই; আমাদের খালাম্মা, আমাদের মমতাময়ী মা বেঁচে নেই- এটা যেন বিশ্বাস হয় না। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত। তবুও রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু মেনে নিতে পারি না। পরপারে, না ফেরার দেশে অনেক ভালো থাকবেন খালাম্মা। আমিন সুম্মা আমিন। আসুন না একবার পেছন ফিরে তাকাই। কিশোরী বয়সে পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলেন বলে রাবেয়া খাতুনের পরিবারে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। বড়রা ভেবেছিলেন, একটি মেয়ের হাতের লেখা সংসারের বাইরের পুরুষদের দেখা অসামাজিক কাজের তুল্য। এই ঘটনা প্রমাণ করে নারী হিসেবে কী রকম অবরুদ্ধ সমাজের বাসিন্দা ছিলেন রাবেয়া খাতুন। এ অবস্থা থেকে উঠে এসে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখকের স্বীকৃতি পেয়েছেন রাবেয়া খাতুন। তার এই অনন্য দৃষ্টান্ত লেখকদের জন্য অনুকরণীয় এবং অবশ্যই অনুপ্রেরণার।

রাবেয়া খাতুনের হাসিমাখা মুখটাও সবার কাছে অনেক প্রিয়। আরও বেশি প্রিয় তার ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনিসহ সাহিত্যের বিশাল জগৎ। রাবেয়া খাতুন অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছেন। উপন্যাসের সংখ্যা দেড় শতাধিক। বিজয়ের ৫০ বছরে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার লেখা ফেরারি সূর্য, নীল নিশীত, বাগানের নাম মালনীছড়া, মেঘের পরে মেঘ, একাত্তরের নয় মাস, একাত্তরের নিশান তরুণদের পড়া উচিত।

সম্পাদক, আনন্দ আলো