আমরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করি- সমাজে 'দৃষ্টান্তমূলক' শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ দ্রুত কমে আসবে। তাই আমাদের দেশে যখনই কোনো ভয়ংকর অপরাধ হয়, তখন সমস্বরে অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা দাবি করি। কিন্তু অপরাধ দমনে শাস্তির ভূমিকা কতটুকু? শাস্তি দিয়ে কি সত্যিই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়? হত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড কতটা প্রভাব রাখে- এ নিয়ে অপরাধবিজ্ঞানীরা দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, সমাজে অপরাধী তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ বজায় রেখে শুধু শাস্তি নিশ্চিত করে অপরাধের প্রকোপের উল্লেখযোগ্য কোনো তারতম্য হয় না। শুধু সাম্প্রতিক ইতিহাসেই নয়; ভবিষ্যতের বাংলাদেশেও বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা এক নৃশংসতম অপরাধ হিসেবেই আলোচিত হবে। শুধু একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের 'অপরাধে' একজন মেধাবী তরুণকে হত্যা করেছে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষার্থীরা! কাউকে পেটাতে গিয়ে হঠাৎ শরীরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আঘাত লেগে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে কাউকে হত্যা নিশ্চিত করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এর জন্য ভিন্ন ধরনের মন-মস্তিস্কের প্রয়োজন। তাই আবরারকে হত্যা করার নৃশংসতা আমাদের সবাইকে ক্ষতবিক্ষত করেছে; ক্ষুব্ধ করেছে স্বাভাবিকভাবেই। আবরারের পরিবার এবং এ দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বস্তি দিয়ে অতি চাঞ্চল্যকর মামলাটির প্রাথমিক রায় হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মামলা হওয়া, বিচার শুরু হওয়া, বিচার শেষে রায় হওয়া এবং সে রায় কার্যকর হওয়া যেন যুদ্ধজয়ের মতো ব্যাপার। এই পুরো প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও অনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আলোচনার স্বার্থে ধরে নিলাম, দ্রুতই রায় কার্যকর হয়ে 'দৃষ্টান্তমূলক' শাস্তিও কার্যকর হবে। কিন্তু সমাজে অপরাধের প্রকোপ কমাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হলো, অপরাধে যুক্ত মানুষদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাদের অপরাধী হয়ে ওঠার কারণ বোঝার চেষ্টা করে তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে কেবল শাস্তি দিয়ে এই ধরনের বীভৎসতা দমন করা যাবে না। আবরারের হত্যাকারী কারা; তাদের পরিবার, বেড়ে ওঠা, আর্থসামাজিক অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম বিস্তারিত রিপোর্টিং করেনি। তবে তাদের কয়েকজন সম্পর্কে কয়েকটি পত্রিকা এবং নিউজপোর্টাল কিছু তথ্য আমাদের জানিয়েছে। তাদেরই একজন রবিনকে নিয়ে কিছু তথ্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

রবিনের বাবা মাকসুদ আলি রাজশাহীর কাপাসিয়া গ্রামের ভারুয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং সে সময় আওয়ামী লীগের কাটাখালি শাখার ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত নিউজপোর্টালকে বলেছিলেন, তার ছেলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা খারাপ কিছু নয়। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি নিজে রাজনীতি করি এবং আমার ছেলেও করে। আমাদের মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতারাও যুবক বয়সে রাজনীতি করেছেন। এভাবেই তারা আজকের রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন।

কথা বলেছিলেন রবিনের ভাবিও। তার মতে, রবিনকে এই মামলায় ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। সে কিছুতেই নিজের সহপাঠীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। তিনি বলেন, মানুষ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য। ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরও অনেকে চাকরি পায় না। কিন্তু রাজনৈতিক সংশ্নিষ্টতা থাকলে চাকরি পাওয়া যায়। সত্যি বলতে রবিনের ভাবির এই শেষ কথাগুলোই আমাদের সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝতে দারুণভাবে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে রবিনের মতো মেধাবী ছেলেরা দেশের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটিতে পড়তে গিয়ে কেন এমন অপরাধী হয়ে ওঠে, তা নিয়ে একটি ধারণাও পাওয়া যায় এ বক্তব্য থেকে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধরনের শাসনব্যবস্থা চলমান, তাতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত না থাকলে তার পক্ষে এই সমাজে অস্তিত্ব রক্ষা করাই দুরূহ; প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো পরের কথা। বিরোধীদের কথা বাদই দিই। 'দলনিরপেক্ষ' মানুষদেরও বর্তমান বাংলাদেশে তার যোগ্যতা অনুযায়ী অবস্থান পাওয়া একেবারেই অনিশ্চিত। রবিনের পরিবার আর যথেষ্ট নয়, সে নিজে কতটা সক্রিয় সেটা তার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; বর্তমান বাংলাদেশে মেধা-যোগ্যতার চেয়ে যার প্রয়োজন অনেক বেশি। রবিনের ভাবি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যখন বলেন, 'মানুষ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য'; তখন কথাটি নতুন কিছু বলে মনে হয় না। কিন্তু একটি আওয়ামী পরিবারের এক সদস্যের এ উক্তি আমাদের কাছে আবারও প্রকাশ করে- কেন বর্তমান বাংলাদেশে 'গাছের পাতা'ও আওয়ামী লীগ করে। কেনইবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের মধ্যে ভয়ংকর খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

আমি ছাত্ররাজনীতির বিরোধী নই। তাই সবকিছুর পরও বলতে চাই, রবিন রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু রাজনীতি মানেই কি একটা ভিন্নমতের স্ট্যাটাস দেওয়ার 'অপরাধে' কাউকে স্রেফ পিটিয়ে মারা? খুন করা দূরে থাক; দেশপ্রেম প্রকাশকারী একটি স্ট্যাটাসের জন্য কাউকে সামান্য আঘাতও কি করা যায়? ক্ষমতাসীন দলটিতে সত্যিকারের রাজনীতি করা মানুষের চাইতে অনেক বেশি দরকার 'মানুষ ঠ্যাঙাতে পারা' মানুষদের। ২০১৮ সালে অনেক সংসদীয় আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থ এবং পেশিশক্তির অধিকারীদের মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এমন মানুষ বেছে নেওয়ার কারণ, দেশের কোনো প্রান্তে নূ্যনতম প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হওয়ামাত্রই তারা যেন বল প্রয়োগ করে তা দমিয়ে দিতে পারেন।

ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে বুয়েটে। সত্যিকারভাবে ছাত্ররাজনীতি করে নিজেকে জাতীয় রাজনীতির জন্য প্রস্তুত করতে চান, এমন তরুণ সেখানকার ছাত্রলীগের বড় পদে স্থান পাননি- এটা নিশ্চিত। পেয়েছেন তারাই, যারা মুহূর্তেই যে কাউকে পিটিয়ে আহত করে ফেলা থেকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারেন। দেশের রাজনীতি আর সমাজে এমন পরিস্থিতি জিইয়ে রাখলে নতুন নতুন রবিন সৃষ্টি হতেই থাকবে। তাই এ পরিস্থিতি না বদলে কিছু ছাত্রকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা: সংসদ সদস্য ও কলাম লেখক