এটা মোটেই অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশে এখন এক ধরনের বন্ধ্যত্ব বিরাজ করছে, যেটি মূলত অর্থনৈতিক এবং যার প্রভাব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিলক্ষণ পড়েছে। বন্ধ্যত্ব আগেও ছিল, কিন্তু এত সংগ্রাম এবং তথাকথিত উন্নয়নের পরও আমরা বন্ধ্যত্বের প্রকোপ থেকে মুক্তি পাব না, বরং তার বিস্তার দেখে হতাশাগ্রস্ত হবো- এটা মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটেছে। এই বন্ধ্যত্বের কারণ কী? কারণ নিশ্চয় একাধিক; কিন্তু প্রধান কারণ একটিই। সেটি হলো, দেশপ্রেমের অভাব। এটা কোনো তত্ত্বকথা নয়, বাস্তবিক সত্য। দেশপ্রেম অর্থ হলো, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। যে ভালোবাসা মানুষকে মানুষ রাখে, তার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে তোলে এবং সেই সঙ্গে সম্মিলিত উদ্যোগে ব্রতী করে। একা কেউই কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, অন্যের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রয়োজন হয়। এই সহযোগিতা ও সমর্থন লাভের সবচেয়ে সুন্দর, সহজ ও কার্যকর উপায় হচ্ছে দেশপ্রেম। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি; সম্ভব হয় পরস্পরকে উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করে তোলা; সর্বোপরি একটি সমষ্টিগত স্বপ্টেম্নর লালন ও পালনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া যায়। সমস্যাটা হলো এই দেশপ্রেম আগে যতটা ছিল, এখন ততটা নেই।

আগে আমরা জানতাম, শত্রু হচ্ছে বিদেশি। সেই শত্রু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখে আমাদের শোষণ করছে। ওই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম শক্তিশালী হয়েছে। এখন রাষ্ট্রক্ষমতা দেশি মানুষদের হাতে। যেহেতু তারা দেশীয় এবং নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে জনগণকে বিভক্ত করতে অত্যুৎসাহী ও সক্ষম, তাই তাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনটা জমে ওঠে না এবং আবার এর পেছনে যে দেশপ্রেম দরকার, তাও আর বিকশিত হয় না। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের যে আদর্শ দেশের ক্ষমতাবানরা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন, তার প্রভাবে সাধারণ মানুষও দেশের কথা না ভেবে কেবলই নিজের স্বার্থের কথা ভাবতে চান। উভয় কারণেই সমষ্টিগত মুক্তির যে স্বপ্টম্ন অতীতে আমাদের পরিচালিত করত এবং কঠিন দুঃসময়েও আশাবাদী করে রেখেছিল, সে স্বপ্টম্নটি এখন আর কার্যকর নেই। বস্তুত সেটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দেশপ্রেম হারিয়ে আমরা ভীষণভাবে আত্মপ্রেমিক হয়ে পড়েছি। দেশে জ্ঞানী-গুণী আর দক্ষ লোকের কোনো অভাব নেই। আমাদের লোকেরা বিদেশে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু দেশপ্রেমের অভাবের দরুন জ্ঞান, গুণ ও দক্ষতাকে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বন্ধ্যত্বের আসল কারণটা রয়েছে এখানেই।

আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটা হলো, কৃষিকে অবহেলা করা। আমাদের স্বাভাবিক নির্ভরতা হচ্ছে কৃষির ওপর। তাকে উপেক্ষা করে যে আমরা এক পা-ও এগোতে পারব না- তার প্রমাণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর দেশে এখন যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে তার মধ্যে পাওয়া যাবে। কৃষিকে অবজ্ঞা করার ঘটনা কেবল যে বাংলাদেশে ঘটেছে, তা নয়। এটি বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থারই একটি অংশ বটে, যে পুঁজিবাদ কৃষিকে ব্যবহার করে ঠিকই কিন্তু উৎসাহী থাকে বৃহৎ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। আমরাও ওই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনেই রয়েছি। অন্যদিকে, আরেক ঘটনা ঘটে চলছে। সেটা হলো ঋণ বৃদ্ধি। বাংলাদেশ বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ করেছে- এটা আমরা জানি। কিন্তু এখন যেটা করছে তা হলো, দেশি ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ঋণ গ্রহণ। সরকারি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেয়ে অনুৎপাদনশীল সরকারি খাতগুলোতেই খরচা বাড়ছে। প্রয়োজনে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তা করা দরকার ব্যাংক থেকে নয়; দেশবাসীর কাছ থেকে। এ জন্য নানা ধরনের বন্ড বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রেও অভাব যেটির সেটি অন্যকিছু নয়; দেশপ্রেমেরই। দেশপ্রেমের সমস্যাটা দূর করার জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক আন্দোলন দরকার। যারা দেশপ্রেমিক তাদের প্রথম কর্তব্য হলো, এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে গভীরতা ও ব্যাপকতা দেওয়া। নইলে সংকট থেকে আমরা কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারব না।


কথা ছিল দিনবদলের; সেটা ঘটছে কি? না, ঘটছে না। এমনকি আওয়াজটা পর্যন্ত যেন ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অভিজ্ঞতা জনগণকে আশাবাদী হতে শিক্ষা দেয়নি। চারদলীয় জোটের যে দুঃশাসন, দুর্নীতি, জঙ্গি তৎপরতায় মদদদান, চোরাচালানি তৎপরতা ইত্যাদি কর্মব্যস্ততায় মানুষ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল; অন্তত ওই জোটের খপ্পরে আরও পাঁচ বছরের জন্য পড়তে যাতে না হয়, এটা ভেবেই তখন দলে দলে গিয়ে হাজির হয়েছিল ভোটকেন্দ্রে। এখন যতই সময় যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে- দিনবদল ঘটবে না। জনগণ গণতন্ত্র চায় এবং স্বৈরাচার পছন্দ করে না, তা সামরিক, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচিত- যে ধরনেরই হোক না কেন। মহাজোট দেশে যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। জনগণ অতীতের শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে বহুদলীয় মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। মহাজোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ। সেই বলে বলীয়ান হয়ে তারা তো আগের শাসকদের মতোই আচরণ করে চলেছে। তবে এতে যে কেবল জনগণের ক্ষতি হচ্ছে, তা নয়। যারা এখন দেশ শাসন করছেন, তাদের জন্যও যে ব্যাপারটা ক্ষতিকর হবে, তাতে সন্দেহ নেই।

গণতন্ত্রের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে স্থানীয় শাসন। স্থানীয় শাসনের অর্থ হলো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। আর এই বিকেন্দ্রীকরণের মূল কথাটা হলো তৃণমূলে স্থানীয় মানুষই নিজেদের দেখভাল করবে। কর্তৃত্ব থাকবে তাদের হাতেই। কেন্দ্রীয় শাসন অবশ্য থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, তবে সে শাসনের পরিধি যতটা খাটো হবে, সমাজের ততটাই উপকার হবে। স্থানীয়ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। স্থানীয় মানুষ যতটা সম্ভব নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই নেবেন। কিন্তু শাসনক্ষমতা এই বিকেন্দ্রীকরণে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই উৎসাহ দেখায়নি। অথচ আমাদের সংবিধানের ৪৯, ৫৯ ও ৬০ ধারায় পরিস্কারভাবে বলা আছে, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অধীনেই থাকবে। এও বলা আছে, স্থানীয় শাসন স্থানীয় মানুষদের স্বার্থের তদারকি করবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বও হবে তাদেরই। স্থানীয় সরকার কর আরোপ করা এবং নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের অধিকারও পাবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
সংবিধানের অনেক কিছুই কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার-সংক্রান্ত বিধানগুলো এখনও অক্ষত রয়ে গেছে। তদুপরি বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার রয়েছে। তাই আশা করা গিয়েছিল, দিন বদলের হাওয়া সেখান থেকেই বইতে শুরু করবে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন; কিন্তু উপজেলায় সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমনিতেই রাজধানী অতিকায় হয়ে উঠেছে। গ্রামে কর্মসংস্থান নেই; সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। গ্রাম শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে তো বটেই, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অভাবেও।

সমাজে ভালো দৃষ্টান্তের বড়ই অভাব। সে দৃষ্টান্ত অনেক সংসদ সদস্যের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না শাসক শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছাত্র সংগঠনের কাছ থেকেও। ভালো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে না যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার তাদের অনেকের কাছেও। তাহলে দেশপ্রেম কি হারিয়েই গেল? এমতাবস্থায় আমরা কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কি গড়তে পারব?

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়