ঢাকা থেকে বরগুনাগামী 'অভিযান-১০' লঞ্চে শুক্রবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪০ জনের প্রাণহানি আমাদের নৌদুর্ঘটনায় নতুন এক ভয়ংকর সংযোজন। ঘটনাটি যতটা না আমাদের বেদনাতুর করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। রোববার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে লঞ্চটি পরীক্ষামূলক ইঞ্জিনে চলছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত যাত্রীদের ভাষ্যেও পদে পদে লঞ্চটির অব্যবস্থাপনার চিত্রই স্পষ্ট করছে। এমনকি আগুনের সূত্রপাতের সময় লঞ্চটির কর্মীদের অবহেলা ও অসহযোগিতার বিষয়ও সমকালের প্রতিবেদনে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হয়েছে। লঞ্চটিতে আগুন লাগার পরপরই এটি তীরে না ভিড়িয়ে চালিয়ে নেওয়ার প্রশ্নটিও এসেছে বড় হয়ে। বস্তুত এ অঘটনে এত অধিক সংখ্যক হতাহতের দায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যেমন এড়াতে পারে না; তেমনি লঞ্চের চালক ও সেখানকার স্টাফরাও দায়মুক্ত নন।

লঞ্চগুলোতে প্রায় সব সময় ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী তোলার অভিযোগ রয়েছে। এ অঘটনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, লঞ্চে ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ যাত্রী নেওয়া হয়েছে। লঞ্চটির মালিক অন্তত কুড়িটি অগ্নিনির্বাপক থাকার দাবি করলেও মেলেনি একটিও। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রয়োজনের সময় লাইফ জ্যাকেট কিংবা লাইফবয়াও পাননি যাত্রীরা। প্রাথমিক ধারণায় বলা যায়, লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও সেখানে 'ঘি' হিসেবে কাজ করেছে ক্যান্টিনে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার। আগুন লাগার পরও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে না দেখে লঞ্চটি বেপরোয়া গতিতে চালানোসহ চালকের যোগ্যতা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। আগুন লাগার পর জরুরি সহযোগিতার জন্য ৯৯৯-এ কল দেওয়ার পরও ফায়ার সার্ভিস যথাযথ সময়ে কেন পৌঁছেনি? দুঃখজনক হলেও সত্য, যে পানি আগুন নেভাতে সাহায্য করে; লঞ্চটি তার ওপর থাকলেও ব্যবস্থাপনাগত সংকটে সেটি সম্ভব হয়নি। লঞ্চের স্টাফদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে।

নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের যেভাবে ভূমিকা রাখা দরকার, এ অঘটন তদারকির সে ঘাটতি আরও ভালোভাবে সামনে এনেছে। লঞ্চে আগুন লাগার বড় ঘটনা হিসেবে এটি প্রথম হলেও সাধারণভাবে নৌদুর্ঘটনা কমাতে যে ধরনের আগাম ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন কিংবা যেসব নিরাপত্তা সামগ্রী লঞ্চে থাকা প্রয়োজন, সেগুলো আছে কিনা তাও দেখার যেন কেউ নেই। বিআইডব্লিউটিএ, নৌপুলিশ কিংবা নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বশীলরা ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী নেওয়া হচ্ছে কিনা, সেটিও যে নিয়মিত দেখছেন না- এ ঘটনা তারই প্রমাণ। যানবাহনের ফিটনেস দেখা, চালকের দক্ষতাসহ লঞ্চের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করাও তার বাইরে নয় বলে আমরা মনে করি। স্বাভাবিকভাবেই সুগন্ধা নদীতে 'অভিযান ১০'-এর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রায় সব দুর্ঘটনায় এমন কমিটি গঠন করলেও সমকালের শনিবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী তার দৌড় তদন্ত পর্যন্তই। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নজির তেমন নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলো বাস্তবায়নেও উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরাও একমত- ওইসব প্রতিবেদনের আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দুর্ঘটনা এড়ানো কিংবা হতাহতের ঘটনা কমানো সম্ভব হতো।

বলাবাহুল্য, নদীমাতৃক দেশে নৌপথের যেভাবে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন, সেভাবে না পাওয়ার কারণেই নৌপথের নিরাপত্তায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ পথে দেশের উল্লেখযোগ্য যাত্রী চলাচল করার পরও এ অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়। সড়কপথে যেভাবে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে; নৌদুর্ঘটনা সেদিক থেকে কম হলেও একটি দুর্ঘটনাই কতটা ভয়াবহ হতে পারে- এ অঘটন তারই প্রমাণ। আমরা মনে করি, প্রশাসন যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নৌপথে দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় পৌঁছানো অসম্ভব নয়।

এ অঘটনে রোববার লঞ্চ মালিকসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমরা দেখতে চাইব, দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অপরাধী পার পেলে এ ধরনের মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তার ব্যাপারে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনার চেয়ে যে কোনো সহায়তা সামান্য হলেও প্রতিটি পরিবার যেন তা পায় এবং ভবিষ্যতেও যেসব পরিবারের সহায়তা প্রয়োজন, সেদিকে প্রশাসন সুদৃষ্টি দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।