সাক্ষাৎকার: সাঈদ ইফতেখার আহমেদ
সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে
সাঈদ ইফতেখার আহমেদ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৫৬
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের স্কুল অব সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। পড়াচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি শাস্ত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং পিএইচডি। শিক্ষকতা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্দার্ন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে
সমকাল: সমস্যাযুক্ত নির্বাচন বারবার ঘটলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: সমস্যাযুক্ত নির্বাচন কখন ঘটে? কেবল বাংলাদেশ নয়, গণতান্ত্রিক বিশ্বেও কর্তৃত্ববাদ একটি প্রভাবশালী মতবাদ। কর্তৃত্ববাদীরা গণতান্ত্রিক একটা রূপ দিয়ে শাসন বজায় রাখতে চায়, বৈধতা দিতে চায়। এই পরিস্থিতি থেকে সমস্যাযুক্ত নির্বাচন হয়ে থাকে। এর ফলে একটা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়, একচেটিয়া রাজনৈতিক ধারা চালু হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক ধরনের গণতান্ত্রিক পরিসর জারি রাখা হয়, যতক্ষণ না তাদের মৌলিক স্বার্থে আঘাত লাগে। এভাবে তারা নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে উপস্থাপন করতে চায়। মূলত এ ধরনের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি কর্তৃত্বপরায়ণ। এমন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র দাঁড়ায় না; গণতন্ত্র না দাঁড়ালে বিচারব্যবস্থা দাঁড়ায় না। এসব পরিস্থিতির উদ্দেশ্য কেবল কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নয়। এগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত। মূলত এসব স্বার্থ রক্ষার জন্যই তারা এ ধরনের শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। তা ছাড়া অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত থাকে দুর্নীতি। এসব কিছু বজায় রাখার জন্যই তারা সমস্যাযুক্ত নির্বাচন করে।
সমকাল: এ দেশের মানুষ খুব নির্বাচনমুখী। যেমন– ১৯৩৭, ১৯৫৪ কিংবা ১৯৭০-এর নির্বাচনের কথা স্মরণ করা যায়। এমনকি দেশভাগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রেও ছিল নির্বাচন। এ রকম একটা দেশে কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হলো না?
সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: এটা একটা বড় ট্র্যাজেডি। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য যতবার রক্ত দিয়েছে, বিশ্বের অন্য কোথাও এ রকমটা ঘটেছে কিনা জানা নেই। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছি। চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক চরিত্রে আমরা গণতান্ত্রিক। তাহলে কেন আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারলাম না? সমস্যার গোড়া মূলত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে খুঁজতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বাধীন হয়, তখন প্রস্তাব উঠেছিল তারা একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা। কিন্তু যারা নেতৃত্বে ছিল তারা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। তারা ঔপনিবেশিক সামন্ততন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসেছিল। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতও গণতান্ত্রিক ধারায় হেঁটেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা গান্ধীজির কথা স্মরণ করতে পারি, তিনি শাসনভার হাতে নেননি। শুরু থেকে এ ধরনের নেতৃত্বগুণ আমাদের নেতারা দেখাতে পারেননি। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিও তাদের শাসনামলে একই আচরণ করেছে। জাতীয় পার্টি বা জাসদ কিংবা অন্য ছোট দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধের সঞ্চার ঘটেনি। গণতন্ত্রের মূলে আছে উদারতাবাদ, সর্বজনীন অধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এই মূল্যবোধগুলো পাবেন না। তাদের মনের গঠন গণতান্ত্রিক নয়।
সমকাল: নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ছিল। সেই ধারাটি কি বন্ধ হয়ে গেছে?
সাঈদ ইফতেখার: জি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু আমাদের দেশে নেই। ২০২৪ সালে সেরকম একটি প্রতিযোগিতাবিহীন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এটি একেবারে সিলেক্টেড বা বাছাই করে সাজানো একটি নির্বাচন ব্যবস্থা। নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা সংশয় থাকে– কে জিতবে কিংবা কে হারবে! কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমরা আগেই বুঝতে পারি ক্ষমতায় কারা আসবে। এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এটা কি ইলেকশন নাকি সিলেকশন– সেই প্রশ্ন ওঠে। এরা বলছে কিংস পার্টি। আমার মতে, এ ক্ষেত্রে কুইন্স শব্দটা বলা উচিত, যা তথাকথিত বিরোধী দলের ক্ষেত্রে ঘটছে। সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে ছোট ছোট অনেক দল ছিল। তারাও নির্বাচনে অংশ নিত। মূল পার্টিগুলো ৮০ বা ৯০ শতাংশ আসন রেখে বাকিগুলো তাদের ছেড়ে দিত। বাংলাদেশের মডেলটা হুবহু সেরকম না হলেও প্রায় সেদিকে ধাবিত হয়েছে।
সমকাল: উত্তর কোরিয়া, রাশিয়াসহ অনেক দেশ প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন ছাড়াও টিকে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত, সেখানে রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন ছাড়া কি টিকে থাকা যাবে?
সাঈদ ইফতেখার: এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না বলে দেওয়া সম্ভব নয়। রাশিয়ার পক্ষে পুঁজিবাদী পশ্চিমা ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা সম্ভব। তার সেই অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা আছে। কিউবার মতো রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে টিকে থেকেছে। উত্তর কোরিয়া টিকে থেকেছে চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে। আজকের বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে কিনা তা নির্ভর করছে দেশের শাসকরা বৃহদাকার শক্তিগুলো যেমন– ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কীভাবে লেনদেন চালাবে তার ওপর। একইভাবে দেখতে হবে এই পাঁচটি শক্তিধর রাষ্ট্র ও ইউনিয়নটি কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। দুই তরফে কী ধরনের সক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে, সেটাই হবে মূল ব্যাপার। প্রতিটা দেশই লেনদেনের সময় জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দেবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ কতটা মিলবে আর কতটা মিলবে না। অন্যদিকে চীন ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এগুলো কিন্তু সাংঘাতিক রকমের নির্ধারক ভূমিকা রাখে। তাই বাংলাদেশের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসনকাঠামো টিকবে কিনা, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোর ওপর নির্ভর করছে।
সমকাল: বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চেয়ে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বেশি তুলনাযোগ্য। দেশটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে কর্তৃত্ববাদী ধারায় যেতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেল।
সাঈদ ইফতেখার: বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তেমন সংকটের দিকে না গিয়েও ট্র্যাজেডি হচ্ছে, আমরা গণতান্ত্রিক ধারা রক্ষা করতে পারিনি।
সমকাল: ভূরাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কি বদলে দিচ্ছে? ভূরাজনীতির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের ভূঅর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা? বিশেষ করে আমাদের রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য যে পশ্চিমা বাজার, তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে।
সাঈদ ইফতেখার: পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের আইনগুলোর পুরোটা মূল্যবোধ বা নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে গ্রহণ করে না। তারা বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে একেকরকম সিদ্ধান্ত নেয়। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে একরকম, মিয়ানমার সম্পর্কে একরকম, ইসরায়েলের বেলায় একরকম। মার্কিনপন্থি অনেক ভাষ্যকারের মধ্যে দেখবেন যে, সারাবিশ্বে পশ্চিমা বিশ্বই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছে। বিষয়টা কিন্তু এরকম নয়। তাদের স্বার্থগুলো পূরণ হয়ে গেলেই তারা মানবাধিকার ভঙ্গ করছে, নীতি-নৈতিকতা উপেক্ষা করছে, গণতন্ত্রের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। যখনই তারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না, তখনই তারা মতপ্রকাশের ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে, গণতন্ত্রের ব্যাপারে জোর দিচ্ছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে বিশ্বরাজনীতিতে অর্থনীতির চেয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই ভূরাজনীতিতে তারা কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশকে বিবেচনায় নেবে। তাদের ভূরাজনৈতিক কৌশল কিংবা সামরিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না কিংবা গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে– এসব কারণে কিন্তু তারা স্যাংশন কিংবা অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। যদি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নাও হয়, কিন্তু তাদের স্বার্থ যদি হাসিল হয় কিংবা তাদের ভূরাজনৈতিক চাহিদার সঙ্গে যদি মিলে যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতি নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কোনো কারণে শাসনক্ষমতা এসব বিষয় ঠিক রাখতে ব্যর্থ হলে কিংবা পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারলে, ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চাপগুলো জেঁকে বসার আশঙ্কা আছে।
সমকাল: প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন সমাজকাঠামোর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
সাঈদ ইফতেখার: সমাজ ও রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। এ ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, উপার্জনের মধ্যে ব্যাপক ফারাক তৈরি হয়, অভিজাতদের সুবিধা বেড়ে যায়। রাজনৈতিক কারণে সমাজের প্রান্তিক জায়গা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের নির্বাচনকে স্রেফ ত্রুটিপূর্ণ বলা যাবে না। কেননা এমন নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক জনগণকে রাজনীতির প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। এ কারণে বিশাল জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। সেটা স্থানীয় সরকার থেকে সর্বোচ্চ সংসদ পর্যন্ত। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামো তৈরি হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শামিল হওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার কথা ছিল না। আমরা কিন্তু এই বাংলাদেশ চাইনি, একটি যথাযথ গণতন্ত্রশাসিত বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। যেমন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মসহিষ্ণুতার কথা বলতে চেয়েছি। সব ধর্মকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন– এটাই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা। এই বাংলাদেশ আমরা তৈরি করতে পারিনি। আসন্ন প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহণ ঘটছে না। সেটা ৪০ শতাংশ কিংবা ৬০ শতাংশ হতে পারে। প্রশ্ন হলো, ১ শতাংশ জনগণও কেন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে থাকবে? এ ধরনের নির্বাচন জনগণকে রাজনৈতিকভাবে বিযুক্ত করে রাখে, যা সমাজের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি জন্ম দেয়। একজন ব্যক্তি ভোটের মধ্য দিয়ে তার মতামত, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে যুক্ত করে। এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে সমাজে অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে।
সমকাল: বর্তমানে সরকার অনেক শক্তিশালী, বিরোধী দলগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও কি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে না?
সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: কর্তৃত্ববাদী শাসনকাঠামোর কোনো জনভিত্তি নেই, এটা একটি ভুল ধারণা। জনভিত্তি নিয়েই সে টিকে আছে। কত শতাংশ সমর্থন তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। বিজেপির কিন্তু জনগণের মধ্যে একটা শক্তিশালী ভিত আছে। তাই বিরোধী দলগুলো বিজেপির শাসনক্ষমতাকে অবৈধ বলে দাবি করতে পারছে না। তাই প্রশ্নটা শতাংশের নয়; বরং জনগণের কাছে তার অবস্থান কেমন এবং কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলটির গ্রহণযোগ্যতা আছে। রাজনৈতিকভাবে বৈধতার প্রশ্নটাই জরুরি। দলের আদর্শিক ও নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে গেলে দাপটের ভিত্তিতে শাসন করতে হয়। এটা তো রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। ক্ষমতার সব খুঁটি একসঙ্গে মিলে তাদের স্বার্থকেন্দ্রিক এক ধরনের শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে। এটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর একটি রূপান্তর। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো এরকম ছিল না। প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাবাদের পাশাপাশি নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ চেপে বসে। এমন শাসনকাঠামোর মধ্যে অর্থনৈতিক শোষণ তীব্র হয়, সরকার বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
সমকাল: আসন্ন নির্বাচনে (২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি) বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই। অথচ ক্ষমতাসীন দলের সদ্যরাই স্বতন্ত্র, ডামি হয়ে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। এটা শাসকদলের গৃহবিবাদ তীব্র করবে কিনা?
ইফতেখার আহমেদ: নির্বাচনে বাইরের লোকেরা সহিংস হবে কিনা তা বলা মুশকিল, তবে দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি। রাজনীতিতে আদর্শকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক লাভালাভকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ঘটছে। এ ধরনের নির্বাচন যদি বারবার হতে থাকে এবং বিরোধী দলগুলোকে ক্রমশ দুর্বল করে দেওয়া হয়, তাহলে অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক চাপসহ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্ব বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমনকি অভ্যন্তরীণ এই কোন্দল আত্মঘাতীও হতে পারে।