ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

ফিলিস্তিন

যিশুর জন্মভূমি বেথলেহেমে নীরব বড়দিন

যিশুর জন্মভূমি বেথলেহেমে নীরব বড়দিন

ছবি: সংগৃহীত

মিশেল চেবিন

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১:০৩ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১:১৪

ফিলিস্তিনের শহর ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবস্থিত বেথলেহেম যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থান। ক্রিসমাস বা বড়দিনের আগে বেথলেহেমের সড়কগুলো সাধারণত পর্যটক বাস ও রঙিন পোশাকের তীর্থযাত্রীতে ভরা থাকত। অথচ এ বছর প্রায় ফাঁকা। হোটেলগুলো খাঁখাঁ করছে, রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ। নেটিভিটি চার্চ এলাকার বেশির ভাগ দোকানও বন্ধ। যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থানের এই গির্জার দিকে যাওয়ার পাহাড়ি সড়কটি কেবল সাদামাটা ক্রিসমাস সাজে সজ্জিত। বিশাল ক্রিসমাস ট্রির মাধ্যমে দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন এবার অনুপস্থিত। কারণ, গাজা উপত্যকায় চলছে ইসরায়েলি হামলা। 

ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার গাজার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শনে বেথলেহেমের খ্রিষ্টান নেতারা স্থানীয় খ্রিষ্টানদের আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপন করতে নিষেধ করেছেন। এর পরিবর্তে তারা যুদ্ধের শিকার নিরীহ মানুষের জন্য প্রার্থনা আরও জোরালো করতে বলেছেন। বেথলেহেমের স্থানীয় প্রশাসনও ‘গাজার মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে’ আগে থেকে স্থাপন করা বড়দিনের সাজসজ্জার অবকাঠামো অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে। জেরুজালেমের ফাদার ও চার্চপ্রধানরাও নভেম্বরে এক বিবৃতিতে ‘অপ্রয়োজনীয়ভাবে উৎসব আয়োজন না করে’ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে ‘দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে’ বলেছেন। পাদ্রিদের বড়দিনের আধ্যাত্মিক দিকে আরও বেশি মনোযোগ এবং ‘প্রিয় পবিত্র ভূমির ন্যায়সংগত ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য’ আন্তরিকভাবে প্রার্থনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

জেরুজালেম থেকে মাত্র ছয় মাইল দক্ষিণে বেথলেহেম। ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েল সামরিক প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে গাজায় যে হামলা চালিয়ে আসছে, তাতে প্রায় ২০ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে। ইসরায়েলের হামলায় সামরিক-বেসামরিক মানুষ নির্বিচারে হতাহত হয়েছে এবং নিহত বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

এই যুদ্ধ বেথলেহেমের বাসিন্দাদেরও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের কাছে বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে বিদেশি ফ্লাইট বাতিলের পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে পশ্চিম তীরকে সিলগালা করার ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের কারণে বেথলেহেমের ঐতিহ্যবাহী খ্রিষ্টীয় পর্যটন ধ্বংস হতে চলেছে। তাতে প্রশমিত হয়নি পশ্চিম তীরের উত্তেজনা। সেখানে ২০০৫ সালের পর এ বছর সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক অভিযান, সহিংসতা ও ফিলিস্তিনি বসতভিটা ছিনিয়ে নিতে সেটেলারদের হামলায় এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে।

বেথলেহেমের অধিকাংশ মানুষ পর্যটনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এ যুদ্ধ তাদের জন্য কঠিন সময় নিয়ে এসেছে। বলা বাহুল্য, সেখানকার পর্যটন মাত্র কভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। গত বছর আশা করা হয়েছিল, বড়দিন উপলক্ষে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার পর্যটক বেথলেহেম পরিদর্শন করবে। ২০১৯ সালের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ১ লাখ ৫০ হাজার পর্যটক বেথলেহেম সফর করে। এ বছর অবশ্য বেথলেহেমের স্থানীয় ব্যস্ত দোকান বেশির ভাগই বন্ধ। ইসরায়েল আংশিকভাবে বেথলেহেমের ভেতরে এবং বাইরে চেক পয়েন্টগুলো ফের চালু করলেও তারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের নতুন কাজ শুরু করার অনুমতি দেয়নি। 

এ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বেথলেহেমের বাসিন্দারা নিজেদের তুলনামূলক ভাগ্যবান বলে মনে করে। শহরটিতে জন্মগ্রহণকারী হাজুবনের ভাষায় এর কারণ হলো, ‘তারা জানে, গাজায় কী ঘটছে। সেখানে তাদের খ্রিষ্টান ভাইদের পরিস্থিতিও’ তারা জানেন। সিএনইডব্লিউএর আঞ্চলিক অফিস জেরুজালেমে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে গাজার ক্ষুদ্র খ্রিষ্টান কমিউনিটিকে সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। গাজায় যুদ্ধের আগে সেখানে খ্রিষ্টানের সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার। হাজবুন ও জেরুজালেমের এক চার্চ কর্মকর্তার মতে, যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহ থেকে গাজার খ্রিষ্টানদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে হয় গাজা ত্যাগ করেছে, না হয় অভিবাসনের জন্য ভিসার আবেদন করেছে। গাজায় অবস্থিত সেন্ট পোরফিরিয়াসের ঐতিহাসিক গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে অনেক ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ১৯ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় ১৮ জন খ্রিষ্টান প্রাণ হারায়। জেরুজালেমের ল্যাটিন ফাদারের মতে, শনিবার গাজার হলি ফ্যামিলি প্যারিস চার্চে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আরও দুই খ্রিষ্টান প্রাণ হারায় এবং সাতজন সেখানে বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়।

অক্টোবরে হামাসের আক্রমণের আগে বেথলেহেমের বাসিন্দা ট্যালি নেসার প্রতিদিন ইসরায়েলি চেক পয়েন্ট পাড়ি দিয়ে ইসরায়েলের একটি স্টোরে কাজ করতে যেতেন। তাঁর নির্মাণ শ্রমিক স্বামীও একই কাজ করতেন। নেসার বলেন, ‘বেথলেহেমে আমরা যা উপার্জন করতে পারি, ইসরায়েলে তার দ্বিগুণ, কখনও কখনও তিন গুণ উপার্জন করতাম।’ নেসারের পরিবার বছরের পর বছর যে অর্থ সঞ্চয় করেছে, তা দিয়েই এখন জীবন চালাচ্ছে। তাঁর ৭ বছর বয়সী মেয়ে জানে, সেখানে যুদ্ধ চলছে। বেথলেহেমের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকলেও সে মাকে বলেছিল, ‘আমি খেতে চাই না। কারণ গাজার বাচ্চাদের খাবার নেই।’

মিশেল চেবিন: সাংবাদিক; ইউএস নিউজ থেকে সংক্ষেপিত, ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×