রাজনীতি
নির্বাচন বর্জনে বিএনপির অর্জন কী হলো?
.
মনোয়ার রুবেল
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৩:০৪
গত সপ্তাহের খবর– বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, নির্বাচন করলেও সরকার ক্ষমতায় টিকতে পারবে না (মানবজমিন)। বিএনপি হয়তো মেনে নিয়েছে, নির্বাচন হতেই যাচ্ছে। আপাতত ঠেকানোর কোনো পথ আর নেই। অথচ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব বক্তব্য বিএনপি দিয়েছে, তা দলটির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ডিসেম্বরের আগে সরকারের পতন হবে– নিতাই রায় চৌধুরী (সমকাল ৪ মার্চ, ২০২৩)। অক্টোবরেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে– আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (ইত্তেফাক ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। জনগণ ৭ জানুয়ারি সরকারের পতন দিবস উদযাপন করবে– রিজভী (সারাবাংলা ২৫ নভেম্বর, ২০২৩)। অসহযোগ আন্দোলনেই সরকারকে সরানো হবে– মঈন খান (ইত্তেফাক ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩)। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করা হবে– ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকন (আলোকিত বাংলাদেশ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩)। এখন নজরুল ইসলাম খান বলছেন ‘নির্বাচন করলেও সরকার ক্ষমতায় টিকতে পারবে না’!
বিএনপি ১৯৮৬, ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে গেলেও ভোটগ্রহণের দিন দুপুরের পর থেকে বর্জন করে। ২০২৪ সাল নিয়ে চতুর্থবার সংসদ বর্জন করতে চলেছে দলটি। আওয়ামী লীগও ১৯৮৮, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ২০০৭ সালে হতে যাওয়া নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু বর্জনের মধ্য দিয়ে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের অর্জন বেশি।
১৯৮৮ সালে নির্বাচন বর্জনের মাত্র এক বছর ৯ মাসের মাথায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পদত্যাগ করতে হয়। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের দুই সপ্তাহের মাথায় খালেদা জিয়া সরকার পদত্যাগ করেন। ২০০৭ সালে ২২ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর সেই নির্বাচন আর অনুষ্ঠিতই হয়নি। বিএনপির আশীর্বাদপুষ্টু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল এবং জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ইতিহাসের এ সহজপাঠ জরুরি এ জন্য যে, নির্বাচন বর্জন একটি চূড়ান্ত কঠোর সিদ্ধান্ত। মাঠে বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে ‘বর্জন’ কার্ড খেলে ফেলা উচিত নয়। বিএনপি এ কাজটিই করেছে। নির্বাচন বর্জনের পর হাতে আর কোনো ট্রাম্প কার্ড থাকে না। বিএনপিরও নেই।
বারবার আওয়ামী লীগ দাবি করে– তারা নির্বাচনমুখী দল। এতটাই নির্বাচনমুখী যে, ১৯৮৬ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল। বিএনপি সেবার নির্বাচনে যায়নি। তারা এজন্য আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু দেখা যাবে, শুধু এরশাদই নয়, ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের যুক্তি, নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো পথ নেই বলে তারা বারবার নির্বাচনে যায়, এমনকি সামরিক শাসকের অধীনেও।
নির্বাচন বর্জন একটি গণতান্ত্রিক কৌশল, কিন্তু তা হতে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা বিজয় নিশ্চিতের জন্য। বিগত এক দশক ধরে বিএনপি নির্বাচনে না আসার পরে অর্জন কী হয়েছিল? হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ভুক্তভোগী করা ছাড়া আর কিছু ঘটেনি। আসন্ন নির্বাচনে একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে বরং আওয়ামী লীগ এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশিই নির্ভার। কোনো প্রতিপক্ষ নেই, দুশ্চিন্তা নেই।
নির্বাচনের পরও বিএনপি-জামায়াত নবগঠিত সরকার ফেলে দেবে সে সম্ভাবনা নেই। বরং দলটি গত কয়েক বছরে প্র্যাকটিস ও লবিং করে যে পরিস্থিতি সহায়ক করে তুলেছিল তা নির্বাচনে না এসে বিফলে চলে গেল কি?
বর্জনের আগের যেটি সবচেয়ে জরুরি ছিল শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা। বিএনপি অন্য কিছু বিশ্লেষণ না করে শুধু ঝুঁকিটুকু নিয়েছে। নির্বাচনে না যাওয়ার ঝুঁকি। এ সিদ্ধান্ত আবেগে নেওয়া কি? হতে পারে। কিন্তু দশকের পর দশক একটি দল যখন নির্বাচনের বাইরে থাকে তখন তারা জনবিস্মৃত হতে পারে। বন্ধুমহল ছেড়ে যেতে পারে। যে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের কথা সংসদে বলতে না পারা, এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছু করতে না পারলে জনগণ বছরের পর বছর তাদের সমর্থন দিয়ে রাখবে না। এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে থাকতে হয়। সরকারে থাকা মানেই ক্ষমতায় থাকা নয়। সংসদে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, স্বতন্ত্র সব মিলিয়ে সামষ্টিকভাবে সরকার হয়। বিএনপি ভাবছে ক্ষমতায় থাকাই সরকার। তাই তারা ‘শুধু’ ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে।
দেড় দশকে যে স্থানচ্যুতি হয়েছে, বিএনপি তা এক ঝড়েই দখল করতে চায়। সেটি কি আদৌ সম্ভব? হারানো মাঠ ধীরে ধীরে দখল করাই রীতি।
বিএনপি সে পথে যায়নি। টানা নির্বাচন বর্জন করে করে স্থান দখলের সম্ভাবনাও হারিয়েছে। বিএনপির ‘দলত্যাগী’ নেতারাও এসব বলছেন। তাদের বিএনপি উপেক্ষা করতেই পারে; কিন্তু কথাগুলো অস্বীকার করবে কীভাবে?
মনোয়ার রুবেল: কলাম লেখক