ফিলিস্তিন
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে

.
নাসরিন মালিক
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ২৩:১৪
ঘটনাটি ছোট কিন্তু প্রভাব অনেক বড়। সেটি হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মিসরে কোনো রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়নি। দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেনের নির্দেশ ছিল– ‘মধ্যপ্রাচ্যকে আমার ডেস্ক থেকে দূরে রাখো’। তাঁর ধারণা ছিল, আরবদের বিষয় অনেকটা সমাপ্ত। এমনকি হামাসের হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগেও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য এখন কয়েক দশকের তুলনায় শান্ত।’ পরিকল্পনা ছিল আরব রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করে অঞ্চলটিকে ‘শেষ পর্যন্ত একীভূত করা’ এবং ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ন্ত্রণে আনা। পণ্ডিত এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছিলেন, ‘ওয়াশিংটন এবং অন্য কোথাও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তনের কথা বলতে খুব শোনা যায়, যেন ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সমাজ এবং এর অগণিত মানুষকে একটি বয়ামে অনেক চীনাবাদামের মতো নাড়িয়ে দেওয়া যায়।’
কিন্তু তাদের পরিকল্পনা কাজ করেনি। (হামাসের) ৭ অক্টোবরের হামলায় মধ্যপ্রাচ্য বাইডেনের ডেস্কে ফিরে আসে। অঞ্চলটি বয়ামে থাকা চীনাবাদামের মতো নয়। পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের পরিবর্তে আরবদের নিজস্ব পরিকল্পনা এবং আঞ্চলিক প্রত্যাশা রয়েছে। ফলে তাদের নিয়ে অন্যের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন। আমরা দেখছি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও বৃহত্তর আরববিশ্ব এমনভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলি মিত্রদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি; তারাও আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে শীতল করতে সে ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
ইসরায়েলকে শক্তিশালী করাই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়। ইসরায়েল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার এবং দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সমর্থন পাচ্ছে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিকি হ্যালি গত সপ্তাহে এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘ইসরায়েল কঠিন প্রতিবেশীবেষ্টিত উজ্জ্বল এক দেশ। এমনটি কখনোই (হয়নি) যে আমেরিকাকে ইসরায়েলের প্রয়োজন। বরং এটি সব সময়ই এমন যে, ইসরায়েলকে আমেরিকার প্রয়োজন।’
এ যুক্তির চড়া মূল্য দিচ্ছে আমেরিকা। সে জন্যই ‘মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের ভয়’। কিন্তু সত্য হলো, যুদ্ধ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি এখন লেবানন, ইয়েমেন, ইরান, লোহিত সাগর ও আরব সাগরে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ লেবানন সীমান্তে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। নভেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় দামেস্ক বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যায়। গত সপ্তাহে বৈরুতের কেন্দ্রস্থলে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় একজন হামাস নেতা ও আরও ছয়জন নিহত হন। এতে লেবাননের দক্ষিণে হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ আরও জোরদার হয়েছে। গাজায় বোমা হামলার প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুতিরা ইসরায়েলের জাহাজে আঘাত করেছে ও জব্দ করেছে। লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার ফলে নৌপথে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দিকে যাওয়া বাণিজ্যিক যানগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে সুয়েজ খাল থেকে মিসরের আয় কমে গেছে এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক সংকটে দেশটির স্থিতিশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
লোহিত সাগরকে নিরাপদ করা না গেলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যয় আরও বাড়বে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে সম্প্রতি এলাকাতে সামরিক তৎপরতা বেড়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার তাদের ওপর গুলি চালানো হুতি নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইয়েমেনে হুতি ঘাঁটির তৎপরতা বন্ধে শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে। এতে পরিবেশকে অস্থিতিশীল করা এবং ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইরান এরই মধ্যে লোহিত সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে।
তবে এ দেশগুলোর প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ঝুঁকি কম এবং এটি হবে আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু এর মধ্যে মিথ্যা স্বস্তি এবং লুক্বায়িত হুমকি উভয়ই আছে। পুরো অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রক্সি শক্তিগুলোর মাধ্যমে ইরানের যুদ্ধ করার ক্ষমতা। কিন্তু ঝুঁকি তার চেয়েও বেশি। তবে প্রক্সি গ্রুপগুলোর ওপর গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রভাব কতটা রয়েছে, তা মূল্যায়ন করা কঠিন। আরবি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো ধ্বংসযজ্ঞের সম্প্রচার করে। আলজাজিরা আরবি চ্যানেল হামাসের নিহত রাজনৈতিক নেতার জানাজা ও দাফন সম্প্রচার করে, ঠিক যেমন আরবি চ্যানেলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে মক্কা থেকে সাপ্তাহিক জুমার নামাজের চিত্র সম্প্রচার করে। লাখো ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানে বাস করে। এ অঞ্চলজুড়ে জনসাধারণের বক্তৃতা, খাবার টেবিল থেকে টকশো এবং সংবাদপত্রের খবরে গাজা যুদ্ধের প্রাধান্য স্পষ্ট। ইরানে সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদের ভয় দেখা যাচ্ছে।
যদি এমন হয় এবং যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিঃসন্দেহে প্রেক্ষাপট বা ইতিহাস ছাড়াই ঘটানো হবে। চরম পন্থা এবং আরব বা মুসলমানদের দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত যুক্তরাষ্ট্র কথিত ‘কঠিন প্রতিবেশী’ হওয়ার আরও প্রমাণ। বাস্তবতা হলো, যে স্থিতাবস্থা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আশা করেছিল, তা আরব রাষ্ট্রগুলোর ‘একীভূতকরণে’ রূপ নেবে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে; একই সঙ্গে ইরানকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধীর লয়ে ও নীরবে ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু হামাসের আঘাতে সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। এর পর ইসরায়েল সরকার যে প্রতিক্রিযা দেখাল, তা এ অঞ্চলে স্থিতিশীল শক্তির পরিচায়ক তো নয়ই, বরং আরও উত্তেজনা তৈরির জন্য যথেষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা এটি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে এমন যুদ্ধ বাধবে, যেখানে ইসরায়েলসহ সবাইকে এর জন্য উচ্চমূল্য দিতে হবে এবং সেটি গোটা বিশ্বকেই হুমকিতে ফেলবে।
নাসরিন মালিক: গার্ডিয়ানের কলাম লেখক; গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত, ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক