রাজনীতি
জাপার বদলে এবার কি নতুন বিরোধী গ্রুপ?

হাসান মামুন
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ২৩:২৫
দেশে যে নির্বাচন হয়ে গেল, সেটাকে ‘বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন’ বলে অনেকে অভিহিত করেছিলেন। প্রকৃত বিরোধী দল নির্বাচনে এলে সেটা আর করতে হতো না। অতীতে প্রধান সব দল অংশ নেওয়ার সময়টায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো; সব দল-মতের মানুষ তাতে অংশ নিত উৎসাহভরে এবং জয়-পরাজয়ের অনিশ্চয়তায় ভরা নির্বাচন শেষে কমবেশি শক্তিশালী বিরোধী দল সহজেই পাওয়া যেত। খুঁজতে হতো না। একবার তো রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে আসা একটি দল নির্বাচনে ১১৬ আসনে জয়ী হয়ে বিরোধী দলের জায়গায় এসে বসেছিল। আর এবার কিনা নির্বাচন শেষে বিরোধী দল খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে! এ নিয়ে আসলে সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীন নাটকীয় পরিস্থিতির।
বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন হলে সংসদে বিরোধী দল মিলবে কোত্থেকে? চলতি সংসদেও প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল নেই। এর আগের সংসদেও ছিল না। তখন বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টির (জাপা) কেউ কেউ মন্ত্রিসভায়ও যোগ দিয়েছিলেন। তা নিয়ে কম প্রশ্ন ওঠেনি তখন। জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র জাপা থেকে বলা হয়েছিল, এটা হলো ‘গঠনমূলক বিরোধিতা’। সেই সংসদের বেশির ভাগ আসনে অবশ্য ভোটও করতে হয়নি। যারা প্রধান বিরোধী দল হতে পারত; সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে তারা নির্বাচন বর্জন করায় এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও তখন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এবারও পরিস্থিতি বলতে গেলে ওই রকম ছিল। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা থেকে গেল নির্বাচনের বাইরে। এদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লাইনে ছিল সংসদের বিরোধী দল জাপা, যেটি একই সঙ্গে সরকারের পুরোনো মিত্র। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ। এর পর দীর্ঘ পথপরিক্রমায় জাপা তার মিত্র হিসেবেই থেকেছে; সেটা মন্ত্রিসভায় থেকে এবং না থেকেও। তবে এবারকার নির্বাচনে তারা অংশ নেবে কিনা– এমন একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। দলের তৃণমূল নেতারা এক সভায় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষেই জোরালো মত দিয়েছিল। জাপা চেয়ারম্যানও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এসব বলেও তারা নির্বাচনে গেছেন এবং আসন সমঝোতার ভিত্তিতেই অংশ নিয়েছেন। এটাই বাস্তবতা, তবে ‘আশানুরূপ ফল’ পাননি। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসনের ৫০ শতাংশেও জয় পায়নি জাপা। চলতি সংসদের চেয়েও তাদের আসন নেমে এসেছে অর্ধেকে।
১১ আসন পেয়েও বিরোধী দল হতে অবশ্য বাধা নেই সংবিধানে। সমস্যা দেখা দিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাপার চেয়ে অনেক বেশি আসন পাওয়ায়। ৬০-এর অধিক আসনে জিতেছেন এবং তাদের প্রায় সবাই আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা। দু-একজন ভিন্ন প্রকৃতির স্বতন্ত্র থাকলেও তারাও সরকারপক্ষীয়। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে। এতে ‘হতাশাজনক ফল’ পাওয়ার পর জাপা চেয়ারম্যানও এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। দলটির তৃণমূলে আবার নাকি জোরেশোরে বলা হচ্ছে, এবার নির্বাচনে না যাওয়াই সংগত ছিল। কিন্তু এখন এসব বলে তো লাভ নেই। জাপাকে এখন বরং এ অধিকার প্রতিষ্ঠায়ই লেগে পড়তে হবে যে, আগামী সংসদে তারাই প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দল। স্বতন্ত্ররা তো স্বতন্ত্র; তারা অফিসিয়ালি কোনো দলের প্রার্থী নন।
এখন বিজয়ী স্বতন্ত্ররা কোনো দল গঠন করে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবেন কিনা, নাকি কোনো ‘গ্রুপ’ গঠন করে কাউকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে বেছে নেবেন– এসব প্রশ্নে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হচ্ছে। সংবিধানে নাকি স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। একজন বিশিষ্ট আইনজীবী একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেছেন, সংসদে বিরোধী দল ‘খুঁজে পাওয়া’ নিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা সম্ভবত ভেবে উঠতে পারেননি সংবিধান প্রণেতারা। তারা তো আর জানতেন না, দেশে গণতন্ত্রচর্চা একটি বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে সংসদে বিরোধী দল ‘খোঁজাখুঁজি’র মধ্যে ঢুকে পড়বে! তবে এর কোনো সমাধান নেই– তা নিশ্চয়ই নয়। সহজ সমাধান হলো স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিতদের মূল দলে ফিরে যাওয়া। তখন এর বাইরে মাত্র ক’জন স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন, যারা সংখ্যায় হবেন জাপার চেয়ে কম। তখন জাপা সহজেই প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।
সংবিধানে যেমনই লেখা থাকুক, এ বিষয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই হবে মুখ্য। নির্বাচনটি যার নেতৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে হয়েছে, তিনিই আসলে রাজনৈতিকভাবে স্থির করবেন– এবার কেমন বিরোধী দল হবে সংসদে। তিনি চাইলে নিজ দল থেকে উঠে আসা স্বতন্ত্রদের একাংশ নিয়েও একটি বিরোধী গ্রুপ গঠিত হতে পারে, যারা হবে জাপার চেয়েও বিশ্বস্ত এবং আরও বেশি ‘গঠনমূলক বিরোধিতা’র ভূমিকা রাখবে সংসদে। অপর অংশটি না হয় দলে মিশে যাবে। আসলে জাপাকে নিয়ে তার পরিকল্পনার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত। প্রকৃত বিরোধী দল মাঠে থাকা অবস্থায় সরকারের মিত্র হিসেবে নির্বাচনে ও সংসদে থাকতে থাকতে জাপার এমনই পরিণতি হয়েছে! তার সম্ভাব্য অবস্থান আর ভূমিকাও এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
২০১৪ সালের মতো করে না হলেও দেশে একটা একপক্ষীয় নির্বাচনই হয়ে গেছে এবং যারা এতে জিতে এসেছেন, সবাই মোটামুটি সরকারি বৃত্তের। বিএনপি থেকে বেরিয়ে যারা নির্বাচনে গেছেন, তারাও সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই যা করার করেছেন। তাদের ‘পারফরম্যান্স’ ও পরিণতি অবশ্য ভালো হয়নি। সত্যি বলতে, জাপাও সরকারের সহায়তা না পেলে আরও খারাপ ফল করত। এদিকে নির্বাচনে দলটির থাকা-না থাকা নিয়ে আস্থাও রাখতে পারেনি সরকার। নিজ দল থেকে স্বতন্ত্রদের নির্বাচন করতে দেওয়ার এটাও একটা কারণ ছিল বোধ হয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ‘দেখানো’ আর ভোটের হার বাড়ানোও উদ্দেশ্য ছিল বৈকি। তাতে নির্বাচন কিছুটা হলেও নতুন ধরনের হয়েছে, সন্দেহ নেই। এখন সংসদে গতানুগতিক বিরোধী দল জাপার বদলে নিজেদের ভেতর থেকে একটা নতুন কিছু হলে অসুবিধা কী?
অসুবিধাটা ওখানে যে, এ ধরনের ‘বিরোধী গ্রুপ’ সংসদে থাকলে সেটা কোনো বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ-ও ঠিক, ২০১৪ সাল থেকেই সংসদে এমন কোনো বিরোধী দল নেই, যারা সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। এ জন্যই প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। সে অংশগ্রহণ ‘অবাধ’ও হতে হয়। এতটাই অবাধ যে, তার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে সেই নির্বাচনে। তেমন নির্বাচন হচ্ছে না ২০১৪ সাল থেকেই। সংসদও গঠিত হচ্ছে বিশেষ প্রকৃতির। তাতে বিরোধী দল আসছে সমঝোতা তথা ‘আসন ভাগাভাগি’র ভেতর দিয়ে। অবতীর্ণ হচ্ছে বিচিত্র ভূমিকায়। এতে আর যা-ই হোক, সরকারের ন্যূনতম জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে না। এখন ক্ষমতাসীন দলের ভেতর থেকেই বিরোধী গ্রুপ গঠিত হয়ে সংসদ চললে সেটা হবে আরেক অভিজ্ঞতা। একেও কীভাবে ‘কিছুটা কার্যকর’ করা যায়, তা নিয়েও হয়তো ভবিষ্যতে আলোচনা হবে!
হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক