বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত। বিশেষ করে আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই হাজার হাজার কৃষিশ্রমিক পরিবার কৃষিকাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে সর্বস্বাস্ত হয়। চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জীবন বাঁচাতে হয়। গ্রামের অবস্থাপন্ন জোতদারদের কাছে অত্যন্ত কম মূল্যে আগাম শ্রম বিক্রি করে পরিবারের ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়। রংপুর অঞ্চলের আশ্বিন-কার্তিক মাসের এই অভিশপ্ত অমানবিক বিপর্যস্ত অবস্থাকেই স্থানীয় ভাষায় মঙ্গা বলে। 

১৯৯৮ সালে আরডিআরএস রংপুর এলাকায় আশ্বিন-কার্তিক মাসের (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত) মঙ্গার বিষয় সামনে রেখে গ্রামে গ্রামে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের গবেষণা শুরু করে। মূল বিষয়- কেন এই মঙ্গা! কেনইবা রংপুর অঞ্চলে! কেন অন্য অঞ্চলে নয়! কেন আশ্বিন-কার্তিকে! কেন অন্য মাসে নয়! শুধু আশ্বিন-কার্তিক মাস নয়, সারা বছর কীভাবে চলে গরিব পরিবারগুলো! কোন মাস তাদের ভালো যায়- কোন মাস খারাপ যায়! কেন ভালো, কেনইবা খারাপ!

তথ্য-উপাত্তের গবেষণায় জানা গেল রংপুর অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৬৭ ভাগই কৃষিশ্রমিক। তাদের নিজেদের জায়গাজমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে যে পারিশ্রমিক পান, তা দিয়েই পরিবারের ক্ষুুধা নিবারণ করেন। এই ৬৭ ভাগ কৃষিশ্রমিক ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বোরো ধান, আলু, ভুট্টা, সরিষা, গম, শীতকালীন সবজি, তামাকসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে কাজ পান। এরপর ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে বিভিন্ন ফসল কাটা, মাড়াইসহ বিভিন্ন কাজে এসব কৃষিশ্রমিক নিয়োজিত থাকেন। এসব ফসলের বীজ বপন, রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হয় বিধায় কৃষিশ্রমিকরা এই মৌসুমে সব সময় কমবেশি কাজ পান। ফলে এ সময়ে তাদের খাদ্যাভাব হয় না।    

এরপর আসে বর্ষার আমন মৌসুম জুন-জুলাই-আগস্ট মাস। জুন, জুলাই, আগস্ট মাসের আমন মৌসুমে শতভাগ কৃষকই আমন ধান চাষাবাদ করেন। তখন জমিতে আমন ধান ছাড়া আর কোনো ফসল থাকে না। এ অঞ্চলে আমন মৌসুমে কৃষক দীর্ঘমেয়াদি আমন ধান চাষাবাদ করেন। এগুলো পাকতে ১৫০ থেকে ১৭০ দিন সময় লাগে। আমন ধানের চাষাবাদে বীজতলা তৈরি হয় জুন-জুলাই মাসে। জমি তৈরি হয় জুলাই মাসে। চারা লাগানো হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। পরিচর্যা, সার, নিড়ানি, কীটনাশক ইত্যাদি কাজ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে শেষ হয়ে যায়।   

এরপর ধানিজমিতে ধান পাকার আগে আর কোনো কাজ থাকে না। সাধারণত আমন ধান পাকে নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাসে। সুতরাং, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত, অর্থাৎ পাকা ধান কাটার আগে ধানের জমিতে কৃষিশ্রমিকের আর কোনো কাজ থাকে না। যেহেতু ধান ছাড়া এই সময়ে আর কোনো ফসল থাকে না এবং ধানের জমিতে কোনো কাজ থাকে না, সে কারণে কৃষিশ্রমিকদের এই সময়ে কৃষিকাজ করার কোনো সুযোগ থাকে না। আর কাজ না থাকার কারণে কৃষিশ্রমিকরা এই সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপোস থাকেন। মানবেতর জীবনযাপন করেন। স্থানীয় ভাষায় এটিই মঙ্গা। অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার ভয়াবহ জীবন সংগ্রাম।  

তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর গবেষণার বিষয়বস্তু হলো- অগ্রহায়ণের পাশাপাশি আশ্বিন-কার্তিক মাসেও কৃষক যেন ভালো ফলনসহ পাকা আমন ধান কাটতে পারে। সেসঙ্গে আয়-ব্যয়ের বিষয়টিও গবেষণার বিষয়বস্তু হলো। এ লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত আমন মৌসুমের স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত ব্রি ধান৩৩-এর বীজ সংগ্রহ করা হলো। একই লক্ষ্য সামনে রেখে স্থানীয় স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত পারিজা, সাইটা, কটকতারাসহ আরও কিছু ধানের জাত সংগ্রহ করে গবেষণার কাজ শুরু হলো। দেখা গেল, স্থানীয় ধানের কয়েকটি জাত কম সময়ে পাকল। কিন্তু ফলন কম। এত কম ফলনে কৃষকের মন ভরবে না। তবে ব্র্রি ধান৩৩ এবং স্থানীয় স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত পারিজাকে নিয়ে আবার গবেষণা শুরু হলো। এবার সঙ্গে যুক্ত হলো আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) উদ্ভাবিত ড্রাম সিডার দিয়ে সরাসরি বপন পদ্ধতিতে গবেষণা। পাশাপাশি রোপণ পদ্ধতি তো ছিলই। 


২০০৩ সালে এসে দেখা গেল, ড্রাম সিডার দিয়ে সরাসরি বপন পদ্ধতিতে ব্রি ধান৩৩ জাতের ধান চাষাবাদ করলে ১১৮ থেকে ১২০ দিনের পরিবর্তে মাত্র ১০০ থেকে ১০৫ দিনেই ধান কাটা যায়। ফলনও ভালো। কিন্তু বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে ধান চাষাবাদে সরাসরি বপন প্রযুক্তিটি কৃষক গ্রহণ করেনি। ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর রংপুর অঞ্চলে আরডিআরএস গবেষণা মাঠে ইরি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাংবাদিক এবং স্থানীয় কৃষকদের মঙ্গা নিরসনে ব্রি ধান৩৩ জাতের উপযোগিতা দেখানো হলো। রংপুর অঞ্চলের কৃষক সেদিন ৪ অক্টোবর অর্থাৎ ১৯ আশ্বিন মঙ্গার সময়ে প্রথম আমন ধান কাটা প্রত্যক্ষ করল। হেক্টরপ্রতি ফলন পেল ৪.২ টন, যা অন্যান্য প্রচলিত ধানের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়।

তবে সেদিনের অনুষ্ঠানের সুধীবৃন্দের মধ্য থেকে দুয়েক জন বিরূপ মন্তব্য করলেন। তারা বললেন, স্বল্পমেয়াদি ধানের ফলন অপেক্ষাকৃত কম। সুতরাং এই প্রযুক্তিতে জাতীয়ভাবে ধানের উৎপাদন কমে যাবে। এই বিষয়টিও আমাদের দীর্ঘ গবেষণায় ছিল। এটা ঠিক যে, স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত তুলনামূলকভাবে ফলন একটু কম দেয়। তবে আমাদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, স্বল্পমেয়াদি ধানের বেলায় ৩০-৪০ দিনের চারার পরিবর্তে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করা হয় এবং জমির উর্বরতা অনুযায়ী ৮-১০ ইঞ্চির পরিবর্তে ৬-৭ ইঞ্চি দূরত্বে চারা রোপণ করা হয়। সর্বশেষ উপরি সার প্রয়োগ চারা রোপণের ৪০-৫০ দিনের পরিবর্তে যদি ২৫-৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি ধানের সমপরিমাণ ফলন পাওয়া সম্ভব। আমন ধানের পরে পরবর্তী ফসল অর্থাৎ আলু, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, সরিষা, গম ইত্যাদি ফসল চাষাবাদ করার সঠিক সময় নভেম্বর মাস। কিন্তু প্রচলিত আমন ধান নভেম্বর মাসে জমিতে থাকে বিধায় কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসে এই ফসলগুলোর চাষাবাদ করতে পারেন না। এতে ওই সমস্ত ফসলের ফলন কম হয়। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।

এই কৃষক যদি আমন মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত বেছে নেন, তাহলে কৃষক একদিকে যেমন মঙ্গার সময়ে ধান পাবে, অন্যদিকে পরবর্তী ফসল সঠিক সময়ে চাষাবাদ করতে পারবে। এতে পরবর্তী ফসলের ফলন বেশি হবে। উৎপাদন খরচ কম হবে। কৃষক বাজারমূল্য বেশি পাবে। আমন ধানের ফলন এবং পরবর্তী রবি ফসলের ফলন এই দুই ফসলের মোট ফলনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কৃষক যদি স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষাবাদ করে সঠিক সময়ে রবি ফসল চাষাবাদ করতে পারে, তাহলে শুধু সঠিক সময়ে রবি ফসল চাষাবাদের কারণেই দুই ফসলের মোট ফলন ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বেড়ে যায়। সুতরাং স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষাবাদে জাতীয় উৎপাদন কমে যাবে- এ কথাটি ঠিক নয়, বরং কৃষকের মোট উৎপাদন বেড়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলের মোট খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেদিনের সেই উদ্ভাবিত পরীক্ষিত স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের প্রযুক্তি ২০০৫ সাল থেকেই আরডিআরএসের মাধ্যমে কৃষকের মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কৃষক আজ নিজ উদ্যোগে স্বল্পমেয়াদি আমন ধান চাষ করছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো উৎপাদনক্ষম স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্রি ধান৭৫ নামে স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) বিনাধান-১৭ নামে স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। স্বল্পমেয়াদি হাইব্রিড ধানের জাত চাষ হচ্ছে। এগুলো ভালো ফলন দিতে সক্ষম। অচিরেই এই সব জাত উত্তরাঞ্চলের কৃষক এবং বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলের কৃষক গ্রহণ করবেন।  

মনে পড়ে, ১৯৯৮ সালে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সময়ে, যেখানে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একজন কৃষকের মাঠেও আশ্বিন-কার্তিক মাসে পাকা ধান দেখা যায়নি। ২০২১ সালে উত্তরাঞ্চলে ৪০-৪৫ ভাগ জমিতে কৃষক আশ্বিন-কার্তিক মাসে আমন ধান কাটছেন এবং সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসে পরবর্তী ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন। মঙ্গা আজ স্থায়ীভাবে দূর হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের কৃষিশ্রমিকরা আশ্বিন-কার্তিক মাসে ধান কাটছেন, ফসল মাড়াই করছেন, পেটভরে ভাত খাচ্ছেন। 

ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া; স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী