
বাঙালি জাতীয়তাবাদ আজ বাংলাদেশে বিপন্ন। বিএনপি বা জাতীয় পার্টির শাসনামলে নয়, আওয়ামী লীগ শাসনামলে এটা ঘটেছে। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুও আশঙ্কা পোষণ করতেন। একদিন গণভবনে গেছি, দেখি তিনি গণভবনের চত্বরে বসে গল্পগুজব করছেন। সেখানে বসা তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, খন্দকার মোশতাক এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাত। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, একেবারেই নতুন কথা। সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কোনো আলোচনায় না গিয়ে তিনি বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- তাহের, কেবল মুজিব কোট গায়ে দিলেই প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়া যায় না। বাঙালি জাতীয়তাবাদী হতে হলে এর সংস্কৃতিকে ঘরে-বাইরে গ্রহণ করতে হবে। তারপর খন্দকার মোশতাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, মোশতাক, তুমি এ সম্পর্কে কী বলো? মোশতাক আমতা আমতা করে বললেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলেই তো আওয়ামী লীগে কাজ করছি। বঙ্গবন্ধু তাকে একটু টিজ করার জন্য বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার জাতীয়তাবাদের মাথায় একটি টুপি পরিয়েছো। মোশতাক মাথা থেকে টুপি নামিয়ে হাতে নিয়ে বললেন, আমি যে মুসলমান এটা তার পরিচয়। বঙ্গবন্ধু বললেন, মাথায় টুপি পরে এমন বহু সম্প্রদায় ভারতে রয়েছে। নেহরু অবিকল তোমার মতো টুপি মাথায় দিতেন। তিনি মুসলমান ছিলেন না। টুপি পরে মুসলমান সাজা যায় না। যেমন কেবল মুজিব কোট গায়ে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাজা যায় না।
তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে স্বতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ত্যাগ করা হলে এই ত্রিশ লাখ শহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। মোশতাক বললেন, তোমাকে আজ দেখেছি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে। তোমার শঙ্কার কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
বঙ্গবন্ধু বললেন, মোশতাক, শুধু তোমাদের নিয়ে শঙ্কা পোষণ করব কেন? আমার আওয়ামী লীগের মধ্যেও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একটা বড় অংশ আছে দেখতে পাচ্ছি। তারা এখন মুখ খুলছে না। আমার মৃত্যুর পর তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যদি পাকিস্তানের আদলেই বাংলাদেশ গড়তে হয়, তাহলে এত রক্তপাত করে আলাদা হওয়ার কী দরকার ছিল? মোশতাক বললেন, তুমি ছায়ার মধ্যে ভূত দেখছো। আমরা বেঁচে থাকতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কেউই মাথা তুলতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু চুপ করে রইলেন।
অতীতের এই প্রসঙ্গটা তুললাম এ জন্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যে শঙ্কা পোষণ করতেন, তা আজ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিলেন (পরে অবশ্য ভারতের ভয়ে ইসলামী কথাটা বাদ দিয়েছিলেন)। জয় বাংলা স্লোগান বর্জন করে পাকিস্তানের কায়দায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ প্রবর্তন করেন। মোশতাক তার মাথার টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মাত্র নব্বই দিন ক্ষমতায় ছিলেন। বেশি দিন থাকলে কী করতেন তা বলা মুশকিল। তিনি যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
মোশতাকের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাতিল করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে ফিরে যান। নিজের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ। এই রাষ্ট্রদোহের অপরাধে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী এবং এরশাদের জীবিত থাকাকালেই বিচার করা উচিত ছিল। বিলাতে এই ধরনের অপরাধে মৃত শাসকের দেহ কবর থেকে তুলে বিচার করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তা পারেনি। বরং ক্ষমতার স্বার্থে এরশাদকে কোলে তুলে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তখন জাতির দাবি পূরণের জন্য ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র না হয় বাদ রাখা গেল, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কীভাবে বাদ রাখা গেল? তাতে কি ৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলো? আওয়ামী লীগ এ কাজটি করেছে ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের মাথায় কাঁঠাল রেখে। মোহাম্মদ হানিফই প্রথম দাবি তোলেন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সেখানে সব ধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখার কথাটি বসাতে হবে। আওয়ামী লীগ তাই করে। অর্থাৎ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটি বাদ দিয়ে 'সকল ধর্মের সমান অধিকার' কথাটি বসানো হয়। এভাবে সংবিধান থেকে তারা মৌলিক নীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ রাখায় দেশের প্রগতিশীল মহল তখন মোহাম্মদ হানিফের ক্রুদ্ধ সমালোচনা করে। আওয়ামী লীগ এ সমালোচনা থেকে বেঁচে যায়।
মোহাম্মদ হানিফ আমার বন্ধু ছিলেন। সংবিধান নিয়ে 'তামাশা' হওয়ার পর তিনি লন্ডনে এসেছিলেন। আমার বাসায় এসে তিনি কেঁদেছিলেন। বলেছেন, গাফ্ফার ভাই বিশ্বাস করুন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বাদ রাখার কথা আমি বলতে চাইনি, আমাকে দিয়ে বলানো হয়েছে। আমি হুকুম অমান্য করতে পারিনি।
এই একই কান্না আমার বাসায় বসে কেঁদেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল। বলেছেন, খেলাফতের সঙ্গে আমি আপস করিনি। আপসপত্রটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, যান সই করে তাদের নেতার কাছে দিয়ে আসুন। এই আপস নিয়ে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে কোনো আলোচনা হয়নি।
সাম্প্রতিককালে ৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগের একটি তরুণ অংশ। তাদের মুখপাত্র ছিলেন সদ্য পদত্যাগকারী প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তিনি কিছুদিন আগেও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, আমরা ৭২-এর সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যাবই। তার পরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হলো, তিনি এক অভিনেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে অশোভন আচরণ করেছেন। এ কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। এক সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গে তিনি অশোভন আচরণ করেছিলেন দু'বছর আগে। একটি মহল তখনই সে কথা জানত। তাহলে তখন তাকে সাজা না দিয়ে ৭২-এর সংবিধান পুরোপুরি প্রবর্তনের দাবি তুলতেই সেই পুরোনো অপরাধে শাস্তি দেওয়া হলো কেন- এ প্রশ্ন কার কাছে তুলব?
বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম আজ নয়। ভারতে হাজার বছর ধরে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম। ঈশা খাঁ, বারো ভূঁইয়ারা যেমন বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, তেমনি আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ প্রথম যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন বাঙালির সঙ্গে। নবাব আলীবর্দী দিল্লিকে কর দেওয়া বন্ধ করে বাংলা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
আধুনিক যুগে ভারতীয় রাজনীতিতে দিল্লির আধিপত্য মুক্ত হওয়ার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। সুভাষ বসু কংগ্রেস ত্যাগ করে ফরোয়ার্ড পার্টি গঠন করেন। ফজলুল হক তার প্রথম রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন কেন্দ্রের প্রভাবমুক্ত আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে। তার দলের নাম ছিল নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা পার্টি। এই দল নিয়ে একবার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু'বছরের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান উর্দু সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতির দিকে মুখ ফেরায়। বাংলাকে তারা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দেয়। বাঙালির আবহমানকালের উৎসব যেমন শারদ উৎসব, বসন্ত উৎসব, জারি, সারি ইত্যাদি উৎসবকে জাতীয় উৎসব রূপে গ্রহণ করে। বদরুদ্দিন উমর একে আখ্যা দেন বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হিসেবে।
চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, ফজলুল হকের বাঙালি রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা অনুসরণ করেই শেখ মুজিব জন্ম দেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা জাতীয় জীবন থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের মিলিত সংগ্রামের ফল আধুনিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। বাঙালি জাতীয়তা তার মূল ভিত্তি।
জিয়াউর রহমান বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে তার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। আজ কোনো কোনো আওয়ামী মন্ত্রী ও এমপিদের দেখলে কি মনে হয় তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন? একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় বিষয়গুলো পলিটিক্যাল কালচারে পরিণত করা কেন? আওয়ামী লীগ তো এখন দেশ শাসন করছে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নয়। দেশের অর্থনীতিতেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে ধনতান্ত্রিক নীতি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ কী? আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশেরই বা ভবিষ্যৎ কী? জিয়া যা পারেননি, এরশাদ যা পারেননি, এমনকি খালেদা-নিজামী সরকার যা পারেনি, সে কাজটি কি আওয়ামী লীগ সরকার করবে? অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমাপ্তি তারাই ঘটাবে? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারাই কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
লন্ডন, ২০ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ২০২২
মন্তব্য করুন