দেশের অভ্যন্তরে আনন্দভ্রমণের জন্য কক্সবাজারের নাম আসে সর্বাগ্রে। তবে কক্সবাজারের সহজাত চিত্র আজ আর নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা, আবাসন, হোটেল, যানজট- সব মিলিয়ে এ এক অন্য কক্সবাজার। এক দশক ধরে নিরাপত্তাহীনতা, মাদকের আগ্রাসন ইত্যাদি আতঙ্কের সঙ্গে রোহিঙ্গা তরঙ্গের ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে এ জন্য শুধু রোহিঙ্গাদের দায়ী করা যায় না। তাদের আবাস কক্সবাজার সদর থেকে ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে।

আমরা সবাই জানি, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গারা মূলত কক্সবাজারের দুটি উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষদিক থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গার আগমন ঘটতে থাকে। সর্বশেষ তরঙ্গটি উঠেছিল ২০১৭ সালের শেষদিকে। ২০১৮-এর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার আগমন ঘটে। আগে থেকে থাকা প্রায় পাঁচ লাখের সঙ্গে নতুন তরঙ্গের মানুষ যুক্ত হয়ে প্রায় ১১ লাখ বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ১০ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গার বসবাস কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে। বাকিরা দেশের নানা স্থানে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে গেছে- এমন অভিযোগও আছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনা কক্সবাজারের এই পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এটা অনস্বীকার্য। প্রাণে বেঁচে কক্সবাজারে পাড়ি জমিয়ে তাদের জীবনের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটুক বা না ঘটুক, রোহিঙ্গাদের প্রলম্বিত অবস্থানের ফলে উখিয়া, টেকনাফ, বিশেষ করে কক্সবাজারের দৃশ্যপট আর আগের মতো নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কক্সবাজারকে এখন আগের মতো পর্যটননগরী না বলে 'শরণার্থী পোতাশ্রয়' কিংবা 'এনজিও হাব' বলা যায়।

২০১৭-১৮ সালে রোহিঙ্গাদের একযোগে আগমন কক্সবাজারে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল শরণার্থী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে অনেক বাংলাদেশি উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন এবং দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাবার, কাপড় ও অর্থ প্রদান করেছেন। মুসলিম বাঙালিরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশায় বিশেষভাবে সহানুভূতি দেখিয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং শুভেচ্ছা দূত শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্যাম্পে দুস্থ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং মিয়ানমারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তাদের এই মানবিক সফর আন্তর্জাতিক মনোযোগ, নৈতিক সমর্থন এবং দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি অর্জনে সফল হয়েছে। তবে ২০১৯-এর পর থেকে এরূপ উচ্চ পর্যায়ের সফর খুব একটা প্রত্যক্ষ করা যায়নি।

রোহিঙ্গাদের এই মানবিক দুর্যোগের প্রতিক্রিয়ায় দেশি ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থা কক্সবাজারের দিকে মনোযোগ দেয়। ফলে ২০১৭ সালের শেষের দিক থেকে কক্সবাজার এনজিওর জন্য 'হট স্পট' হয়ে ওঠে। কক্সবাজার পর্যটননগরী শরণার্থীদের উপদ্রব লাঘব করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য, উদ্ভাবনী ধারণা এবং কর্মসূচির প্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছে। এ ছাড়া শত শত স্থানীয় ও বিদেশি গবেষক এই 'পূর্ববর্তী' পর্যটন স্পটকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গবেষণাগারে পরিণত করেছেন। শতাধিক এনজিওতে কয়েক হাজার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পেশাজীবী গবেষক, পরামর্শক ও মাঠকর্মী কাজ করছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা উখিয়া ও টেকনাফে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা দপ্তর স্থাপন করেছে। তা ছাড়া আঞ্চলিক দপ্তরের কেন্দ্রও স্থাপিত হয়েছে কক্সবাজার সদরে। কোনো কোনো সংস্থা নিজেদের কেনা জায়গাতে অফিস স্থাপন করেছে; কোনো কোনোটি আবার বিলাসবহুল হোটেল কক্ষ ভাড়া বা লিজ নিয়েছে। ফলে পর্যটকরা কক্সবাজার ও টেকনাফে হোটেল বুকিং করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়াও বাংলাদেশি এবং বিদেশিরা তাদের আবাসন, ক্যাম্পকেন্দ্রিক প্রোগ্রাম ও চলাফেরার মাধ্যমে কক্সবাজারের পরিধি প্রসারিত করেছেন। বহিরাগতদের নানামুখী সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন ব্যবসার সম্প্র্রসারণ কক্সবাজারকে একটি নতুন রূপ দিয়েছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহন খাত ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়ও পেশাদারিত্ব পুষ্ট হয়েছে। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পরিবহন ব্যবসা শুরু করেছে। কক্সবাজার থেকে উখিয়া-টেকনাফ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শত শত গাড়ি, অটো (সিএনজি) এবং অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কাজের ফলে ক্যাম্পগুলো কক্সবাজার শহর বা সমুদ্রসৈকতের চেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, সোলার প্যানেল, পেট্রোলিয়াম গ্যাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পয়ঃনিস্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অন্য রূপ নিয়েছে। বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত, যারা প্রতি সপ্তাহে তাদের কাজ এবং অন্যান্য অগ্রগতি অবহিত করতে সরকার পরিচালিত সাইট ব্যবস্থাপনার মূল্যায়ন সভায় মিলিত হন। কাজের বৈচিত্র্য বিবেচনায় ক্যাম্প সাইটগুলো আর কোনোভাবেই পরিত্যক্ত বলা যাবে না। পূর্বেকার ফাঁকা পাহাড়ের পাদদেশ এখন যানজটপূর্ণ ব্যস্ততম স্থানে পরিণত।

দৈনন্দিন শত শত দর্শনার্থী, এনজিও কর্মী বা গবেষকদের ক্যাম্পে দুপুরের খাবার সরবরাহ করার জন্য উখিয়া ও টেকনাফে অনেক নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরেও গহনা, ভ্রাম্যমাণ দোকানসহ অন্যরকম দোকানও দেখা যায়।

অতীতে কক্সবাজারের দর্শনার্থীরা সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতেন। বিভিন্ন ক্যাম্পে এখন অনেক এনজিও কর্মী সকালে সদর ছেড়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। এমনটি আজকের কক্সবাজারের প্রতিদিনের চিত্র। সারাদিন ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর ও অসহনীয় পরিবেশে কাজ শেষে, যানজট কাটিয়ে সন্ধ্যায় সদরে ফিরে অনেকে হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে রাতের খাবারের সময় সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যান। সারাদিনের কষ্ট যেন সমুদ্রসৈকতে কিছুক্ষণ হাঁটা এবং সামুদ্রিক মাছের সতেজ পরিবেশনায় তারা ভুলে যান; পরদিন আবার ক্যাম্পে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।

তবে পরিবহন, আবাসন ও গাড়ি, দেশি-বিদেশি মানুষের আনাগোনায় কক্সবাজার মুখর হলেও আগের মতো নিরাপদ নয় এই পর্যটননগরী। ছিনতাই ও প্রতারণা কক্সবাজারকে অনিরাপদ করে তুলেছে। ফলে অনেক পর্যটক সমুদ্রসৈকতে বা রেস্টুরেন্টে আগের মতো সন্ধ্যা বা রাতে নিরাপদ বোধ করেন না। ক্যাম্পের অভ্যন্তরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড (হত্যা), নারী নির্যাতন, বহু ও বাল্যবিয়ে ইত্যাদির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় সমাজে। স্থানীয়দের জীবনে রোহিঙ্গাদের প্রভাবসহ এসব উপসর্গের ফলে দিন দিন স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত বৃদ্ধি পেয়ে তা আতিথেয়তার বদলে হিংসাত্মক ও সহিংস রূপ ধারণ করেছে। অবয়বগত দিক থেকে কক্সবাজারের অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান হলেও কক্সবাজারের স্থানীয়দের জীবনের পূর্বেকার সমাজজীবন, শিক্ষা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পর্যটন ও মাছের ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেক স্থানীয় বাংলাদেশির অভিমত।

এভাবে কক্সবাজারের দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিবেশে রোহিঙ্গাদের জীবনমানের খুব বেশি অগ্রগতি কিংবা তাদের সংকট নিরসনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত না হলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশের কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যের সম্প্র্রসারণ ঘটেছে, তা অনস্বীকার্য। এ নিয়ে অবশ্য সরকারি মহল, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, এনজিও সংস্থার কর্তাব্যক্তি এবং রোহিঙ্গাদের মাঝে টানাপোড়েন রয়েছে। তবে যাদের লক্ষ্য করে এত আয়োজন, তাদের সংকট লাঘব তথা তাদের নিজভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে কক্সবাজারের পরিবর্তিত দৃশ্যপট আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়