
আসাদ চৌধুরী
শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, ছড়াকার হলেও আসাদ চৌধুরী 'কবি' নামেই বেশি পরিচিত। টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সশরীরে যে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থাপক আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠস্বর সবাইকে মুগ্ধ করে। তিনি আমার মতো অনেকের অভিভাবক। ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একই গ্রামের সন্তান হিসেবে এক যুগ ধরে তার স্নেহ-ভালোবাসা পাচ্ছি। মিতভাষী, সজ্জন, হৃদয়বান, ছান্দসিক কবি আসাদ চৌধুরীর জনপ্রিয়তা দুই বাংলায়। তার কবিতায় আছে নতুন সুর। দেশ, দেশের ঐতিহ্য, লোকায়ত জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, সহজিয়া ভাব তার কবিতার উজ্জ্বলতা। আধুনিকতার নামে অকারণ দুর্বোধ্যতা তিনি এড়িয়ে চলেন। তিনি দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী। পায়জামা-পাঞ্জাবি তার প্রিয় পোশাক। শীতে কাঁধে ঝোলানো থাকে উত্তরীয় বা চাদর। তার কাঁধে শোভা পায় পাটের ব্যাগ। পুরো দেশটা তিনি চষে বেড়িয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া ৬৩ জেলায় একবার হলেও গিয়েছেন তিনি। জেলা-উপজেলা এমনকি সুদূর গ্রামবাংলা ও নদী- সবখানে কবি আসাদ চৌধুরীর পদস্পর্শ পড়েছে। বিদেশ ভ্রমণ তার প্রিয় শখ। নিরন্তর 'পান' চিবাতে পছন্দ করা এ মানুষটির মুখে আঠার মতো এক ঝলক হাসি লেগে থাকে। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তবক দেওয়া পান' প্রকাশের পর সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিমান কবি যুক্ত হলো। 'সত্যফেরারী' কবিতায় তিনি লিখেছেন, 'কোথায় পালালো সত্য?/........ প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই/ এমন কি কালোবাজারেও নেই/ কোথায় গেলেন সত্য?'।
আসাদ চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী (ধনু মিয়া) এমএলএ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ১২২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- 'চৌধুরী সাহেবের ব্যবহার ছিল অমায়িক। খেলাফত আন্দোলন থেকে রাজনীতি করছেন। দেশের রাজনীতি করতে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের উলানিয়ার জমিদারি বংশে।' বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে আরিফ চৌধুরীদের ৭১, রাধিকা মোহন বসাক লেনের বাসায় থেকেছিলেন। তখন আসাদ চৌধুরীর মা সৈয়দা মাহমুদা বেগম জাতির পিতাকে আপ্যায়ন করেছেন।
স্ত্রী সাহানা চৌধুরী, এক কন্যা, দুই পুত্র, পুত্রবধূ, জামাতা ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে সুখের সংসার আসাদ চৌধুরীর। তার সংসার এখন আর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। উলানিয়ার মানুষের কাছে একজন অভিভাবক। অনেকের কাছে ডাকনাম 'খসরু ভাই' বা 'খসরু চাচা' হিসেবেও তিনি পরিচিত।
আসাদ চৌধুরীর শৈশবের শিক্ষাঙ্গন উলানিয়া করোনেশন হাই স্কুলের বয়স এখন ১১০ বছর। এর শতবর্ষপূর্তি উৎসবের সভাপতি ছিলেন তিনি। এ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা 'শতাব্দীর বাতিঘর' সম্পাদনার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমার কাঁধে। আমাদের উলানিয়া মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনের শিকার। এলাকাটি রক্ষায় একনেকে পাস হওয়া ৩৮৬ কোটি টাকার কাজ চলছে। এ অর্থ বরাদ্দে উলানিয়ার আরেক সন্তান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে আসাদ চৌধুরীর অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রায় আড়াই বছর পর কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন আসাদ চৌধুরী। দেহটা তার বিদেশে থাকলেও মনটা পড়ে ছিল বাংলায়। আর তাই মাসে অন্তত দুইবার আমাকে ফোন করে এলাকার খোঁজ নিয়েছেন। তার হৃদয়জুড়ে উলানিয়া। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন, তার প্রকৃত বয়স সার্টিফিকেটের বয়সের চেয়ে ৪-৫ বছর বেশি।
আসাদ চৌধুরী তার বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক ও ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। তার কবিতা 'তখন সত্যি মানুষ ছিলাম'-এ লিখেছেন 'নদীর জলে আগুন ছিলো/ আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/ আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার উদাস-করা দৃষ্টিতে/ আগুন ছিলো গানের সুরে/ আগুন ছিলো কাব্যে/ মরার চোখে আগুন ছিলো/ এ-কথা কে ভাববে?/ .....আগুন ছিলো মুক্তি সেনার স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়/ প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে কাঁপছিলো সব-অন্যায় /.... তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/এখন আছি অল্প।' কবি আসাদ চৌধুরীর ৮০তম জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা। প্রিয় কবি, শতায়ু হোন।
মিজান শাজাহান: সাংবাদিক
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন