ভ্রমণ মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক কাজের অংশ। পৃথিবীর আদি থেকে অদ্যাবধি ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, নবী-রাসুলের নাম পাওয়া যায়, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত ভ্রমণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ভ্রমণকে আরবিতে বলা হয় সফর, ছায়ের, রেহলাত ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তে ফিকহি পরিভাষায় সফর বলা হয়, নিজ বাসস্থান বা কর্মস্থল থেকে ৪৮ মাইল বা ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে গমনের উদ্দেশ্যে নিজের মহল্লা বা গ্রাম থেকে বের হওয়া। গন্তব্যে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সফর অবস্থা বহাল থাকে। সফর বা ভ্রমণকারীকে মুসাফির বলা হয়। রাসুল (সা.) এর জীবনে রজব মাসে যে মেরাজ হয়েছিল, সেটিও এই ভ্রমণেরই অংশ।
গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র হয়, তবে সেখানে পৌঁছার পর আর মুসাফির থাকবেন না। আর গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র না হয় এবং সেখানে অন্তত ১৫ দিবস-রজনী থাকার নিয়ত না থাকে, তাহলে সফর অবস্থা বহাল থাকবে। ভ্রমণ একটি আনন্দময় ইবাদত এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার উৎস। সফর বা ভ্রমণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো পূর্ববর্তীদের কীর্তি ও পরিণতি সম্বন্ধে জানা ও শিক্ষা গ্রহণ করা।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সুরা ইউসুফের ১০৯ আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- 'তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল, তা কি দেখে না? যারা মুত্তাকি তাদের জন্য পরকালই শ্রেয়; তোমরা কি বোঝ না?' অন্যত্র সুরা আল-মুমিনের ২১ আয়াতে মহান আল্লাহ আরও এরশাদ করেন- এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত এদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিল। পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে ও কীর্তিতে প্রবলতর। অতঃপর মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন তাদের অপরাধের জন্য এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ ছিল না।'
সুরা আল-মুমিনের ৮২ আয়াতে মহান আল্লাহ আরও এরশাদ করেন- তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না ও দেখে না তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল? পৃথিবীতে তারা ছিল এদের
অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক এবং শক্তিতে ও কীর্তিতে অধিক প্রবল। তারা যা করত তা তাদের কোনো কাজে আসেনি।'
ভ্রমণ বা সফরের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিরহস্য অবলোকন করে জ্ঞানার্জন করা এবং তার কুদরত ও শক্তির প্রতি অনুগত হওয়া।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সুরা হজের ৪৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে- 'তারা কি দেশভ্রমণ করে না? তা হলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন হতে পারত। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে হৃদয়।'
সুরা আনকাবুতের ২০ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- বলো, 'তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো, কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন? অতঃপর আল্লাহ সৃজন করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।'
যাতায়াত ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যানবাহন ও পরিবহন আল্লাহর কুদরতেরই অংশ এবং তা-ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।
পবিত্র কোরআনের সুরা সাবার ৩৪ আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন- 'তাদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, যেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ওইসব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম, 'তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিবস ও রজনীতে।'
ইসলামী আইনবিদদের মতে, সব মুসলমানের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সামর্থ্য অনুযায়ী সফর করা ও ভ্রমণ করা কর্তব্য। সুরা আল ইমরানের ১৩৭ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- 'তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম!'
সুরা আনআমের ১১ আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, বলো, 'তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর দেখ, যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছিল!
সফরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বৈচিত্র্য বিষয় অবলোকন করে জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করা যায়। সফরের মাধ্যমে মানুষের চোখ-কান খুলে যায়। সত্য, সঠিক পথ ও পন্থা গ্রহণে সহায়ক হয়। আল্লাহ তায়ালা সুরা হজের ৪৬ আয়াতে এরশাদ করেন- 'তবে কি তারা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে না, যাতে তাদের অন্তর অনুধাবন করতে পারত এবং তাদের কান (সত্য কথা) শুনে নিত।'
সফরে দোয়া কবুল হয়। সফরকালে চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ কছর, অর্থাৎ দুই রাকাত পড়তে হয় এবং সুন্নত নামাজ নফল পর্যায়ভুক্ত হয়। সফর অবস্থায় প্রয়োজনে ফরজ রোজা পরে রাখা যায়। সফর অবস্থায় ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ এবং কোরবানি ওয়াজিব হয় না। তবে সুযোগ থাকলে আদায় করা উত্তম।
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলে থাকেন, পর্যটন হলো জ্ঞানসমুদ্রের সন্ধান। সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন তথা শারীরিক ও মানসিক উন্নতির জন্য ভ্রমণ করা খুবই জরুরি।
এ জন্যই হজরত শেখ সাদী (র.) বলেছেন, দুনিয়াতে দু'ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী- (১.) ভাবুক বা চিন্তাশীল ব্যক্তি, (২) দেশ সফরকারী ব্যক্তি।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সফরের মাধ্যমে যাবতীয় কল্যাণ লাভের তৌফিক দান করুন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি