
ঐতিহাসিক ১৪ ফেব্রুয়ারি আজ- 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস'। কালের পরিক্রমায় আজ পহেলা ফাল্কগ্দুনও। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ দেশের ছাত্রসমাজ জাতির কাঁধে চেপে বসা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে।
ফাগুনের আগুন প্রতিবাদী ছাত্রসমাজের বুকের রক্তে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোর মতো কালো রাজপথকে রক্তিম করে তুলেছিল। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব কাঞ্চনসহ নাম না জানা আরও শহীদ সাথীকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে একেবারে উল্টোপথে ধাবিত করার চেষ্টা করা হয়। ক্যু-পাল্টা ক্যুর মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা। সামরিক শাসকদের পালাবদল হয় জিয়া থেকে এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ওই দিনই ছাত্ররা স্বতঃস্ফুর্তভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশি বাধায় সে মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার গণঅভ্যুত্থান দিবস, ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ কলাভবনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এই মিছিলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বহু ছাত্রছাত্রী আহত ও গ্রেপ্তার হন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণাঙ্গনে। দিনশেষে সিদ্ধান্ত হয়, ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কখনও পুলিশ প্রবেশ করতে পারবে না। ক্যাম্পাস হয় মুক্তাঞ্চল।
তিন দফা দাবি সামনে রেখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দাবিগুলো হলো- মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল; সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তিদান ও সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
সেই লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত, তখন কেন্দ্রীয় নেতারা যারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতা ছিলাম, আমাদের ঘরোয়াভাবে ডেকে বললেন, অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে যখন আমরা প্রশ্ন করলাম- কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা একান্তে বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় আমাদের নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে জান্তা পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার! শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান; অবশেষে নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়েন অনেকে, যাদের লাশও গুম করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সামরিক শাসককে মোকাবিলা করার জন্য তখনও তেমনভাবে প্রস্তুত ছিল না। তবুও ছাত্র-জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। সেই কারণেই আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করি।
এ কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
১৯৯৩ সালে সেই শক্তির উপদেষ্টা সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন 'ভালোবাসা দিবস'। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতার হলুদাভ বস্ত্র ও গাঁদা ফুলের মর্মর মিলনমেলার আচ্ছাদনে। নগর থেকে বন্দর, রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গন ছেয়ে যায় হলুদাভ ভালোবাসায়।
এখন প্রশ্ন হলো- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যা অর্জন করতে চেয়েছিলাম; আমার মূল্যায়ন হলো, আমরা তা পাইনি। গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। কখনও কখনও আমরা ভোটের অধিকার হারিয়েছি।
সমাজকে এ জায়গা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে। মনে রাখতে হবে- গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের দুর্বলতা সমাজে মৌলবাদ, দুর্নীতি, লুটপাট, নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়। তাই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে আমাদের সোচ্চার হতে হবে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে- আমরা সেই শপথ নিই।
সাবেক ছাত্রনেতা
মন্তব্য করুন