যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু কারা? চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান; এমন বেশ কিছু দেশের নাম বলা যাবে। কিন্তু যদি বলা হয়, এখন দেশটির এক নম্বর শত্রু কে? তাহলে চটজলদি উত্তর দেওয়া কঠিন। অবশ্য বাইডেন প্রশাসনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, শীতল যুদ্ধের মতো এখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু রাশিয়া। যদিও চীনের সঙ্গে ট্রাম্প আমলের বাণিজ্য যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ করেনি যুক্তরাষ্ট্র; উত্তেজনা কমিয়েছে সামান্য।

ট্রাম্প জমানায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও লোকসানের পাল্লা ভারী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যার বড় ভুক্তভোগী মার্কিন নাগরিকরা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চীনের কিছু পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আমদানি শুল্ক্ক বাড়ালে শুরু হয় এই বাণিজ্য যুদ্ধ, যাতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই দেশই পাল্টাপাল্টি শুল্ক্ক বৃদ্ধির ধারা জারি রাখে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন ব্যবসা কাউন্সিল-ইউএসসিবিসির উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা বলছে, দু'দেশের বাণিজ্য যুদ্ধে আড়াই লাখ মার্কিনি চাকরি হারিয়েছেন। অথচ শুল্ক্ক না বাড়ালে ২০২৫ সাল নাগাদ দেড় লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতো! ইউএসসিবিসির এ গবেষণায় কাজ করেছেন অক্সফোর্ডের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, আগামী ৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি হারাবে।

চীনের সঙ্গে এই বাণিজ্য যুদ্ধ আর না বাড়ালেও ইতি টানেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ক্ষমতা গ্রহণের ১১ মাসের মাথায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে দু'দেশের মাঝে চলা উত্তেজনা কিছুটা কমিয়ে আনেন। ট্রাম্পের মেয়াদের শেষ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষি ও শিল্প পণ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও সেবা আরও বেশি আমদানি করার চুক্তি করেছিল চীন। যার ৬০ শতাংশ পূরণ করে দেশটি। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ দেন বাইডেন। তবে আলোচনায় ব্যবসা-বাণিজ্যের বদলে প্রাধান্য দেন উইঘুর, তিব্বত, হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুকে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার আঘাতে গত দুই বছর ধরে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই টালমাটাল। একই সঙ্গে কমেছে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত মধ্যপ্রাচ্য। সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধে রয়েছে স্থিতাবস্থা। যুদ্ধ নেই আফ্রিকাতেও। গত ২২ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি কমেছে ২১ শতাংশ বা ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অস্ত্র বিক্রি কমেছে ৩১ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর সরাসরি মার্কিন অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে ১৭ শতাংশ বা ২১ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন দেশের সরকার সরাসরি মার্কিন অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অথবা মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব অস্ত্র কিনে থাকে। এসবই হয় মার্কিন সরকারের অনুমোদন নিয়ে।

দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এসআইপিআরআইর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১১ শতাংশ অস্ত্রের ক্রেতা সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রেরও সবচেয়ে বড় ক্রেতা তারা। তবে ইয়েমেনে বেসামরিক হত্যা ও মানবাধিকার ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে সৌদি আরবের কাছে আক্রমণাত্মক অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রেখেছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটনের কাছ থেকে শুধু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা কিনতে পারবে রিয়াদ, যা ট্রাম্প জমানার নীতির পুরোপুরি বিপরীত। এসআইপিআরআই বলছে, বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি অস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম ৫টিই যুক্তরাষ্ট্রের। এ ছাড়া বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ৩৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির ৪৭ শতাংশ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। যেখানে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ অস্ত্র বিক্রি হয়।

করোনার আঘাতের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রি কমে যাওয়ার প্রভাব সরাসরি পড়ছে মার্কিন অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার যে নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের অর্থনীতিতে পড়েছে, তা থেকে রাতারাতি উত্তরণ সম্ভব নয়। চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে রাশিয়ার অবস্থান ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠাও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই নিজেদের গড়া নীতি-আদর্শ ঠিক রেখেই বাইডেন প্রশাসনকে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। যার একটি হয়তো হতে পারে ইউক্রেন। সীমান্তঘেঁষা দেশটির সঙ্গে গত ৮ বছর ধরে রাশিয়ার যে বৈরী সম্পর্ক চলছে, তার থেকে ফায়দা তুলতে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করাতে চাইছে- ইউক্রেনে হামলা চালাবে রাশিয়া। এ জন্য প্রচার-প্রচারণার সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করছে ওয়াশিংটন। প্রায় প্রতিদিনই নানা বিবৃতি দিচ্ছে তারা। একই সঙ্গে এই ইস্যুতে যুক্ত করেছে মিত্র দেশগুলোকে। যারা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে হুমকি-ধমকি অব্যাহত রেখেছে। বিপরীতে বারবার কোনো ধরনের যুদ্ধ চায় না বলে রাশিয়া বিবৃতি দিলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এখন যুদ্ধ হোক বা না হোক, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; তাতে ভয় পেতেই পারে ইউক্রেন। যার ফল ঘটছেও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছে দেশটি। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই এ পরিমাণ আরও বড় হবে। শুধু ইউক্রেন নয়; ইউরোপের আরও দেশও হয়তো অস্ত্রের মজুত বাড়াতে শরণাপন্ন হবে যুক্তরাষ্ট্রের। লাভের এই গুড় খেতে চাইবে অস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত এই চাপ সামলাতে রাশিয়া চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। কারণ যে কোনো ধরনের মার্কিন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে রাশিয়ার অর্থনীতিকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং খুচরা পণ্যের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী চীন। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে চীনের সহায়তায় রাশিয়া কীভাবে সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে, সেখানেই নজর রাশিয়ার।

ফুরকানুল আলম: নিউজ এডিটর, চ্যানেল ২৪