
নামের মহিমা বলে একটা কথা চালু আছে আমাদের সমাজে। শুধু আমাদের সমাজেই বা বলি কী করে; পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নামের মহিমা কর্মের চেয়ে অনেকটাই বেশি। যারা কর্মে বিশ্বাসী তারা স্থান পান জনগণের মনে। আর যারা সৃষ্টিশীল কর্মের অধিকারী তারা মূল্য পান আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে। কিন্তু যারা উৎপাদক তাদের কথা কেউ বলেও না, ভাবেও না এবং তাদেরকে প্রচলিত সমাজের যোগ্য মানুষও মনে করে না। এই কথাগুলো মনে হলো সার্চ কমিটিতে ২৪ দলের নামের প্রস্তাব দেখে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২৪টি দল সার্চ কমিটির কাছে নাম জমা দিয়েছে। কোনো দল দিয়েছে ১০টি নাম, কোনো দল দিয়েছে পাঁচ-ছয়টি। কোনো কোনো দল এক বা একাধিক নাম জমা দিয়েছে। এদের বাইরে ছয়টি পেশাজীবী সংগঠনও ২০০ নাম পাঠিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব শফিউল আজিম জানিয়েছেন, পেশাজীবী সংগঠনের দেওয়া নামগুলো বিবেচনায় থাকবে না।
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনারা ইসি গঠনের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়নি। তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এ পদ্ধতি। তারা চাচ্ছে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তাদের বিশ্বাস, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই শুধু [ইতোমধ্যে ওই ব্যবস্থা প্রমাণিত] সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও রিগিংবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে। তাই তারা রাষ্ট্রপতির সংলাপে যেমন যোগ দেয়নি, তেমনি কোনো নামের তালিকা করেও জমা দেয়নি।
রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে আসা নাম বিবেচনা করার কোনো আইনি সুযোগ নেই। আইনে শুধু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই সিইসি ও ইসির জন্য যোগ্যদের নামের সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কাজে দক্ষ ও যোগ্য, আইনি চিন্তায় প্রজ্ঞার অধিকারী, নির্ভীক ও সাহসী এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখার মতো দৃঢ় মনোবলের অধিকারীদের নামই সার্চ কমিটি আশা করেছে। তারা চাচ্ছে নির্বাচন কমিশন যে দুর্নাম কুড়িয়েছে; নতুন নির্বাচন কমিশন যেন তার প্রতিরূপ না হয়।
সার্চ কমিটিতে আসা ২৪টি রাজনৈতিক দলের দেওয়া নামের তালিকায় একই ব্যক্তির নাম বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের তালিকায় রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। ধারণা করা হয়, এসব নাম রাজনৈতিক সিন্ডিকেশনের ফল। রীতি অনুযায়ী বা সাধারণ যুক্তিতে যে নামগুলো বিভিন্ন দল থেকে এসেছে, তারাই অধিক মাত্রায় যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। গণতান্ত্রিক চেতনার যুক্তিও এমনটাই। সেই চিন্তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সুপারিশে। ছোট দলের তালিকা থেকেও হতে পারেন সিইসি। এটি একটি আন্তর্জাতিক চেতনার ফসল। আমরা জানি, জাতিসংঘে যখন সেক্রেটারি নিয়োগের সময় আসে, তখন আমেরিকা নিজ দেশের বা ইউরোপীয় কোনো দেশ থেকে প্রার্থী দেয় না। তারা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের একজন কূটনীতিককে বেছে নেয়, যাতে কোনোরকম বিতর্ক না ওঠে। যিনি নির্বাচিত হন তিনি মূলত আমেরিকাপন্থিই। অর্থাৎ আমেরিকা যা বলবে তিনি তা-ই করবেন।
আওয়ামী লীগ দাবি জানিয়েছে তাদের দেওয়া নামের তালিকা প্রকাশ না করতে। কেন আওয়ামী লীগ এ দাবি করেছে? ইসি গঠন কি তাদের একক কোনো ব্যাপার? দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে ইসি গঠনের সব প্রক্রিয়া জানা ও বোঝার। জনগণকে অন্ধকারে রেখে ইসি গঠন স্বচ্ছ হবে না। সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানই জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখা ও বোঝার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই দৃষ্টিভঙ্গি বা চেতনার ঘাটতি আছে। সার্চ কমিটি যাদের নাম সুপারিশ করবে, তাদের বিষয়ে জনগণকে জানাতে হলে বিষয়টি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা উচিত। তাহলে জনগণ বুঝত, সরকার সাংবিধানিক বিষয়টি তাদের গোচরে নিয়ে এসেছে। তারা জানতে পারছে, ইসিতে কারা যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদের ইসি নির্বাচন-সংক্রান্ত সাব কমিটির মাধ্যমে শুনানি করে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপ করা যেত। তাহলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়ত। তারা যে জনগণের জন্যই নিবেদিত- এটাও প্রমাণিত হতো। জাতীয় সংসদ সেই নামের তালিকা আইনি ধারায় রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাত এবং রাষ্ট্রপতি তা স্বাক্ষর করে আইনে পরিণত করতেন।
যে তালিকা থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনাররা আসুন না কেন, তারা শ্রেণিচরিত্রে এক। তারা চরিত্রগতভাবে উৎপাদক শ্রেণির। তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা সজাগ-সচেতন হলেও ক্ষমতা শেয়ার করতে অভ্যস্ত নন। আমরা মনে করি, তালিকায় উঠে আসা প্রজ্ঞাবানরা দলনিরপেক্ষ হলেই 'নিরপেক্ষ' নন। তাদের নিজ নিজ পক্ষ আছে। দেশের ৮০ শতাংশ কৃষক-শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষ। এই ৮০ শতাংশ মানুষের কোনো প্রতিনিধি নেই ওই রাজনৈতিক দলের সুপারিশের তালিকায়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই বোধ ক্রিয়াশীল- গ্রামের মানুষ নির্বাচন কমিশন চালানোর মতো গুণ ও যোগ্যতার অধিকারী নন। তাই তারা তাদের পছন্দের লোক তালিকাভুক্ত করেছেন। এরা দু'দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহায়তা দেবে। সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ লোকের কোনো প্রভাব বা তাদের মতামতের কোনো দরকার নেই বা তাদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এভাবেই এ দেশের গণতন্ত্রের মাথায় অগণতান্ত্রিক মনোভাব টোপর হিসেবে বসানো হয়েছে। এই টোপর কে নামাবে?
ড. মাহবুব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন