বাংলাদেশ ভূগোলের সাধারণ মুসলমান প্রাণ মন ঢেলে পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৪৬ সালের গণভোটে বিপুল হারে রায় দিয়েছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর তাদের পরমানন্দ। কিন্তু সে আনন্দকে চরম হতাশায় পরিণত করল পাকিস্তানি শাসকেরা। তারা পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মুসলমানদের নীচ চোখে দেখত। এ অঞ্চলকে শুরু থেকেই শোষণ করার ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের 'ধর্মভিত্তিক ঐক্য' দর্শনের ধোঁকাবাজির কৌশল নিল। পৃথিবীতে আর কোথাও কখনও এমনটা হয়েছে কিনা জানি না, যা নব্য পাকিস্তানের নব্য শাসকরা করেছে, জিন্নাহ-লিয়াকত করেছে; হে পূর্ব বাংলার বাঙালি, তোমরা আর তোমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে না, এরপর থেকে সব লেখা, সব কথা হবে উর্দু জবানে।
পাকিস্তানের পূর্ব ভাগের সব মুসলমান যখন পাকিস্তান পেয়ে খুশিতে বাগ বাগ, তখনই এমন একটা ঘোষণা এলো পাকিস্তানের 'জনক' জনাবের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে, জোরেশোরে খোলাখুলি। না, পূর্ব বাংলার জনগণ যে ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গেই ধরতে পারল, তা নয়। কিন্তু বাংলার তরুণেরা তীক্ষষ্ট, অপরাজেয়। তারা জিন্নাহর সভাস্থলেই দৃপ্তকণ্ঠে পাল্টা ঘোষণা করে, না, না, না। জিন্নাহ বেঁচেছিলেন আর মাস ছয়েক। তার ঘোষণার এমন পরিণতি দেখে যাওয়ার দুর্ভাগ্য তার হয়নি। পূর্ব বাংলার তরুণসমাজ 'ভাষা' প্রশ্নের স্ম্ফুলিঙ্গকে লেলিহান অগ্নিশিখায় পরিণত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে থাকল। এদিকে, অভিজাত নেতৃত্বের মুসলিম লীগকে তৃণমূল অনভিজাতদের মুসলিম লীগে পরিণত করার রাজনৈতিক সংগ্রামও চলছিল পাশাপাশি, এসব ক্ষেত্রে 'অতি জনপ্রিয়' ধর্মান্ধ রাজনীতির পরিবেশে আলো জ্বালার দুঃসাহস যারা দেখিয়েছিলেন, কমবেশি তাদের অনেকের কথাই আমরা নানাভাবে জেনেছি। অনেকেই রাজনৈতিক সংগ্রামে, আন্দোলনে, দুঃখ-কষ্ট বরণে, আত্মত্যাগের ঝুঁকিপূর্ণ পথচলার কমবেশি স্বীকৃতি পেয়েছেন, ইতিহাস মঞ্চেও কারও কারও ঠাঁই মিলেছে। তবে এটা সুনিশ্চিত, মঞ্চের পেছনের নীরব-নিঃশব্দ কুশীলবদের, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সহযোগীদের অনেকেরই নাম আমরা জানি না। খুঁজতেও গবেষণাধর্মী হই না।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ তখন ছিল ভয়ংকর। সামান্য বিরোধিতাকে অসহিষ্ণুভাবে দমন করত তারা। বিশেষত তরুণ প্রতিবাদী মুসলিম লীগপন্থি আর কমিউনিস্টদের ওপর চলল নিষ্ঠুর অত্যাচার। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ক্রমশ ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার শিকড়ে শিকড়ে ঠাঁই করে নিতে থাকল। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তের ফোয়ারা ছুটল বন্দি কমিউনিস্টদের শরীর থেকে। নিহত আর আহত কতজনে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলন ক্রমশ গতিময় হয়ে উঠল। তারপর? মহাকাল আর মহাবিশ্বের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এক শব্দগুচ্ছ : একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার আশ্চর্য সন্তানের অবয়ব দেখে মানবেতিহাস চমকে গেল। এমন উদাহরণ যে নেই। ভাষা সংগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরেরা মহাকাশের নক্ষত্রে পরিণত হয়ে গেল চিরকালের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কার্যত জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম এক নব মানচিত্র বাংলাদেশের ভ্রূণ। রক্তের অক্ষরে লেখা হলো মায়ের ভাষার বর্ণমালা। কালক্রমে সেই একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এমন গৌরব আর কোনো জাতির, কোনো দেশের, কোনো ভাষার নেই।

বায়ান্নর একুশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল বুঝি ভাষা সংগ্রামের সদর দপ্তরে পরিণত হলো। সেখানে সংগ্রামের মাঠ-অধিনায়করা একুশে রাতেই শহীদ মিনার নির্মাণের এক দৃঢ়, দৃপ্ত, দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। শহীদ মিনার বানাতে চাই ইট, বালু, সিমেন্ট। কোথা পাব, কোথা পাব এ রসদ। শুরু হলো এক পবিত্র সন্ধান-অভিযান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ প্রয়োজনে এক গুদামে আছে শহীদ মিনার নির্মাণের উপকরণ। খোঁজ ঠিকাদার। যার ওই উপকরণ ভান্ডার! ওই অনুসন্ধানের পথ খুঁজে খুঁজে আমরা পেয়ে গেলাম একজন ঠিকাদারের গভীরে যেন একজন আশ্চর্য দরবেশ। তার কাছে ছিল গুদামের শুধু নয়, ইতিহাসের চাবি। অনুসন্ধানী ছাত্রদের প্রস্তাবে তিনি সেই ইতিহাস-চাবি তুলে দিলেন ইতিহাসের সজীব সহযোদ্ধাদের হাতে।


তারপর? গুদাম খোলা হলো। ইট, বালু, সিমেন্ট, মিস্ত্রি সব জোগাড় হয়ে গেল নিমেষে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতভর গড়ে উঠল পূর্ব বাংলার প্রথম শহীদ মিনার। যার ছবি আমরা দেখতে পাই। এই অতি জানা ইতিহাসে আমরা একটি খবরই দীর্ঘকাল জানতে পাইনি। ওই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের মালমসলা সরবরাহকারী ঠিকাদারের পরিচয়টুকু!

অদূরেই হোসেনী দালান এলাকায় থাকতেন তিনি। বিদ্রোহী ছাত্রদের প্রস্তাবে এককথায় ওদের হাতে চাবি দিয়ে বললেন, কাজ শেষে চাবিটা ফিরিয়ে দিও। ছাত্ররা সে-কথা রেখেছিল। নিঃশব্দ, দৃঢ়চেতা, দুঃসাহসী এই নেপথ্য মানুষটির নাম পিয়ারু সরদার। বিরুদ্ধ স্রোতে উজানের মাঝি। এমনি বিশ্নেষণের রয়েছে বিস্তারিত পটভূমি।

ইতিহাসের কালচক্রে মোগল বাদশাহদের পক্ষ থেকে বুড়িগঙ্গা ছোঁয়া নওয়াব মহলের হাতে ছিল ঢাকার শাসনভার। শতাব্দীর পর শতাব্দী। পুরান ঢাকায় ইতিহাসের পরতে পরতে গড়ে উঠেছে এক সমাজ। যাদের উৎস মূলত মধ্য এশিয়া ও পরিপার্শ্ব অঞ্চল। ভাষা ছিল এক ধরনের মিশেল উর্দু। ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একজন সরদারের নিকটাত্মীয়কে সতীর্থ হিসেবে পেয়ে চমকে গেলাম। উর্দু জবান নয়। চমৎকার বাংলা। চমৎকার রুচিময় পোশাক। শুনলাম ঢাকার খ্যাতনামা কাদের সরদারের পরিবারের একজন ওই সতীর্থ। পরে বুয়েটে পড়ার সময় পুরান ঢাকার সতীর্থদের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখি আজব কাণ্ড। এত চমৎকার খাবার আয়োজন। এত আদব-কায়দা-তমিজ। পরে আরেক বুয়েট সতীর্থ। পেলাম যিনি পিয়ারু সরদারের নিকটাত্মীয়। তাদের পরিবারের সবাই, অন্যান্য আত্মীয়বর্গ কী দারুণ প্রখর মেধাবী।

পুরান ঢাকায় ১৯৬৩-১৯৬৫ পর্বে ছাত্রজীবন কাটিয়েছি। ওই সমাজের সঙ্গে মিশেছি। ওই নওয়াব সরদারদের কথা জেনেছি। নওয়াবরা ঢাকার শাসন চালাতেন অধীনস্থ ২২ সরদারদের দ্বারা। 'কাদের-মতি-পিয়ারু'-এই তিন সরদার ছিলেন খ্যাতনামা। ১৯৬৫ থেকে আশির দশক পর্যন্ত হোসেনী দালান এলাকায় পিয়ারু সরদার ও তার সন্তানদের প্রশ্রয়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন-যুব ইউনিয়নের সদর দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি।

ফিরে আসি ১৯৫২ সালের একুশে মহাকাব্যে। একটি গণআন্দোলনে কত ধরনের লোক যে নেপথ্যে-প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখে, একুশে ফেব্রুয়ারি সৃজনে কত সহস্র মানুষের যে বিপুল অবদান, সে খবর আমরা জানতেও পাই না। সে সময় উর্দু জবানের প্রায় সমগ্র পুরান ঢাকা ছিল ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে। এমনি পরিস্থিতিতে, পটভূমিতে, পুরান ঢাকার গর্ভ থেকে পিয়ারু সরদারের মতো একজন বিদ্রোহী উজান মাঝি পেয়ে যাব, ভাবতেও পারিনি। অভিজাত নওয়াবদের বাংলা ভাষা বিরোধিতার কথা হাড়ে হাড়ে জানতে পেরেও সেই নবাবি শাসনকে উপেক্ষা করে একজন সরদারের এমনি নিঃশব্দ বিদ্রোহ, তা অকল্পনীয়। এখানেই পিয়ারু সরদার গেঁথেছেন নৈতিকতা আর সাহসের আশ্চর্য মাইলফলক।

সেই বৈরী প্রহরে পুরান ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের সদর দপ্তর গড়ে উঠল পিয়ারু সরদারের সক্রিয় অনুমোদনে। শুনেছি এই সরদারের বাসভবনটি কমরেড মণি সিংহ গোপন রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। ষাটের দশকের মহান গণজাগরণে, শিক্ষা আন্দোলনে, ছয় দফা-এগার দফার আন্দোলন গড়তে ও ছড়াতে, উনসত্তরের অপরূপ গণঅভ্যুত্থানে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতিতে ছাত্র ইউনিয়ন সদর দপ্তরটি ৩১/১ হোসেনী দালানকে ব্যবহার করতে পেরেছে পিয়ারু সরদারের সন্তানদের নিবিড় আশ্রয় ও উত্তাপে। একসময় ৩১/১ হোসেনী দালান পরিণত হলো যুব ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলার উন্মেষ পর্বে। প্রেস রিলিজ তৈরি, রাজনীতির পাঠশালা হিসেবে এই ভবনটি কতকাল ব্যবহার করেছি পরম মমতায় পবিত্র উপাসনালয় হিসেবে। ভাড়া দিতে পারিনি মাসের পর মাস। প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হলেও পৃথিবী আজ দেখছে কত সহস্র শহীদ মিনার। বলা হয়, ত্যাগের নয়, ভোগের সমাজ, ভোগের মহোৎসব এখন পৃথিবীজুড়ে। এরই গভীরে একটি প্রবল সত্য! উজানের মাঝিরা নীরবে-নিভৃতে নেপথ্যে আছেনই। পিয়ারু সরদারেরা আছেন বলেই ইতিহাস মাথা উঁচু করে জেগে আছে। বঙ্গবন্ধু আছেন বলেই একটি মানচিত্রের এমনি আশ্চর্য উত্থান। বৈরী মুহূর্তে যেসব উজানের মাঝি ইতিহাস বদলে দেন মানুষেরই জন্য।

হেরে গেছেন ঢাকার নওয়াব শাসকরা। সেই নওয়াবদের তোয়াক্কা না করা পিয়ারু সরদার জিতে গেছেন ইতিহাসে। একুশে পদকের রাষ্ট্রীয় সম্মানে পিয়ারু সরদার সুরভিত, সুশোভিত। দেশের প্রতিটি ভাষাশহীদ মিনারের গভীরে যেন পিয়ারু সরদারসহ ভাষাসংগ্রামীদের হূৎপিণ্ড সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।

হিলাল ফয়েজী: সম্পাদক, মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট