- মতামত
- ভ্যালেন্টাইনস ডে ও স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে বিরোধ নেই
সাক্ষাৎকার: অসীম সাহা
ভ্যালেন্টাইনস ডে ও স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে বিরোধ নেই

কবি অসীম সাহা সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক (২০১৯), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ (২০১১) উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেন। '৬৯-এর অসহযোগ আন্দোলন ও '৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ সম্পন্ন করেন। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া কবি অসীম সাহার পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জ।
সমকাল: এই সাক্ষাৎকার যেদিন প্রকাশ হবে, সেদিন বসন্ত উৎসব পালিত হবে। আপনি দিনটি সাধারণত কীভাবে পালন করেন?
অসীম সাহা: বসন্ত প্রকৃতি থেকে আসে। মনে বসন্ত থাকার সময়সীমা থাকে। বয়স হয়ে গেলে সেই বসন্তের তারুণ্যের রূপ যৌবনের মতো থাকে না। ক্রমেই সেটি ফ্যাকাসে হয়ে আসে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি সময়কে ধরে বসন্তকে অনুভব করার চেষ্টা করি না। বসন্তের যে মাধুর্য এবং হৃদয়কে আপ্লুত করার ক্ষমতা আছে, তা সারাবছর তারুণ্যের মানসিকতা নিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করি। প্রাকৃতিক যে রূপ-রস ও রং; তা কখন চোখকে অতিক্রম করে হৃদয়কে প্রতারণা করে যে চলে যায়, টেরও পাই না। ২০-৫০ বছর বয়সে যেভাবে বসন্ত উপভোগ্য হয়, সেই ব্যঞ্জনা পরে আর কোনো বসন্তে আসে না।
সমকাল: বাঙালি সমাজ ও বাংলা সাহিত্যে বসন্ত উৎসবের বিশেষ কোনো প্রভাব রয়েছে?
অসীম সাহা: খুব তীব্রভাবে আছে। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এর প্রভাব ব্যাপক। রবীন্দ্র-নজরুল তো বটেই; এমনকি সমকালীন তরুণ কবিদের মধ্যেও বসন্তে প্রকৃতির দোলা প্রতিফলিত হতে দেখি। জীবনানন্দ দাশ এর ব্যতিক্রম। তার কবিতায় হেমন্তের প্রভাব অনেক বেশি তীব্র। হেমন্ত বিষাদের প্রতীক। তাই হয়তো জীবনানন্দ দাশ তার ব্যক্তিগত জীবনে বিষাদময়তাকে কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং অসংখ্য সফল কবিতার জন্ম দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে বসন্ত নানাভাবে নানারূপে ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।
সমকাল: সম্প্রতি বাংলা পঞ্জিকায় পরিবর্তন আনায় পহেলা ফাল্কগ্দুন বা বসন্ত উৎসবের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে'র সঙ্গেও মিলে গেছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
অসীম সাহা: ভালোবাসা দিবসটি প্রধানত তরুণ-তরুণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। যদিও ভালোবাসা নানাভাবে নানাজনের মধ্যে বহুমাত্রিকতা নিয়ে ধরা দেয়। মা-বাবার ভালোবাসা কিংবা মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, তার যে রূপ; এর সঙ্গে তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা একই মাত্রায় প্রকাশিত হয় না। শুধু ভালোবাসা দিবসেই নয়; সারাবছর ভালোবাসার সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবীকে আমরা সুন্দর করে তুলতে পারি। এবারের ভালোবাসা দিবসেও সেটাই আমার প্রত্যাশা। বাংলা একাডেমি যদি সার্বজনীন উৎসবগুলো এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায় একই দিনে পালনের স্বার্থে দিন-তারিখগুলো মিলিয়ে নেয়, সেটাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে।
সমকাল: ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকারের বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে শহীদ হন জয়নাল, দীপালি সাহাসহ অন্তত ১০ জন। সেই 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' এখন আর সেভাবে পালন করা হচ্ছে না কেন?
অসীম সাহা: একুশে ফেব্রুয়ারি আর পহেলা বৈশাখ ছাড়া আর কোন দিবসটি আমরা যথাযথভাবে পালন করছি? ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। কিন্তু সর্বসাধারণের স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমরা মূলত একুশে ফেব্রুয়ারি আর পহেলা বৈশাখেই দেখতে পাই। বাঙালি যে বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি- এর মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে এক ধরনের উদাসীনতা আমাদের জাতীয় দিবসগুলোকে ক্রমেই গৌণ করে তুলছে। এটা বাঙালি জাতির জন্য একটি আত্মঘাতী ভূমিকা বলে আমি মনে করি।
সমকাল: নতুন প্রজন্মের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি মানেই ভ্যালেন্টাইনস ডে। রাজনীতি সচেতন প্রজন্মের কাছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। এই দুইয়ের পালনের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখতে পান?
অসীম সাহা: ভ্যালেন্টাইনস ডে ও স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালনের মধ্যে বিরোধ দেখছি না। দেশ, জাতি ও সমাজকে ভালোবাসলেই না সব ধরনের স্বৈরাচার প্রতিরোধের শক্তি আসে। তবে বিরোধ যেখানে সেটা হচ্ছে, নিজেদের ভেতরে। জাতি যখন জাগ্রত থাকে, তাদের চেতনা যখন জাগ্রত থাকে; তখন এসব দিবস পালনের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ম্ফূর্ত ভূমিকা দেখা যায়। আসলে আমাদের সংস্কৃতির চেতনার মধ্যে এক ধরনের ধস নেমেছে। তার ফলে আমরা কোনটা পালন করব আর কোনটা করব না, তা নির্ধারণে ব্যর্থ হচ্ছি। আত্মঘাতী বাঙালির এই পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
সমকাল: দেশের প্রধান দুই দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির কৌশলগত সম্পর্কের কারণেই কি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালন ক্রমে হারিয়ে গেছে?
অসীম সাহা: প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি আর রাজনীতির জায়গায় নেই। ক্ষমতার দম্ভ এবং অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে রাজনীতি এখন প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং এখনও তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, অনেক ক্ষেত্রে তারাই নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নামে মূলত স্বাধীনতার শিকড় উৎপাটনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। অনেক নেতাকেই দেখি স্বৈরাচারী দলগুলোর ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব। আর সেই সুযোগে উল্লিখিত দলগুলো তার সুযোগ গ্রহণ করার ফলে তাদের প্রতিরোধে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
সমকাল: স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি? একই সঙ্গে চাপা পড়ে যাওয়া জয়নাল, দীপালিদের গৌরবগাথা কীভাবে আবার সামনে নিয়ে আসা যায়?
অসীম সাহা: মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি যদি কৌশলগত কারণেও স্বৈরাচারী শাসকের দলগুলোকে জায়গা করে দেয়, সে ক্ষেত্রে এসব দিবসকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা সেই ইতিহাসকে অন্য কোনোভাবে লিপিবদ্ধ করা কঠিন হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যদি লেখক বা গবেষক এসব দিবস নিয়ে কাজ করেন, তাহলেই এগুলো ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে পারবে। পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রভাবের কারণে অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় বাদ যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যদি এ বিষয়ে নজর দেন, তাহলে নিরপেক্ষভাবে এ অনিবার্য ইতিহাস হয়তো আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও আর্কাইভে সংরক্ষিত হতে পারে।
সমকাল: মজিদ খানের বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কি বৈষম্যহীন?
অসীম সাহা: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই বৈষম্যহীন নয়। আমাদের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাঠ্যবিষয়ের বৈপরীত্য শিক্ষাব্যবস্থাকে তছনছ করে দিচ্ছে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজেরও একই অবস্থা। বাংলা মাধ্যম গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে আমাদের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক ব্যবধান তৈরি হয়েছে। সমাজের ধনিক শ্রেণি তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর জন্য এক ধরনের শৌখিন বাহাদুরিতে মত্ত। ফলে সর্বক্ষেত্রে বাংলা অবহেলিত হচ্ছে। এর মাধ্যমেই শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে আমরা ভয়ংকর রকমের ব্যবধান লক্ষ্য করছি। এ থেকে উত্তরণে একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি।
সমকাল: কেউ কেউ বলেন, ভালোবাসা দিবসের মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে ডুবিয়ে রেখে ইতিহাস থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার 'ষড়যন্ত্র' রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
অসীম সাহা: এটা শুধু ভালোবাসা দিবসের ব্যাপার নয়। সংস্কৃতি যখন একটি জাতির জীবনে গৌণ হয়ে পড়ে; চেতনার বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য জাতিগত কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সরকার ঘুমিয়ে থাকে। তখন জাতীয় জাগরণের জন্য যা কিছু মহান, যা কিছু অনিবার্য তা থেকে সরিয়ে রাখার জন্য অনেক অবাঞ্ছিত বিষয়ের দিকে তারুণ্যকে প্ররোচিত করা হয়। তাদের ঘুমিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। এটা যারা করেন তারা বোঝেনও না; জাতিকে তারা ধ্বংসের কিনারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। জাতি ও রাষ্ট্রকে যদি এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে ঘুমিয়ে থাকা তারুণ্যকে জাগ্রত করার বিকল্প নেই।
সমকাল: ব্যস্ততার মাঝেও সময় দিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অসীম সাহা: আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে সমকালের অগণিত পাঠককে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন