নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সংবাদপত্র 'দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ' কার্যালয়ে শনিবার দুপুরে যে সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙচুর, নির্যাতন ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে; তাতে আমরা উদ্বিগ্ন ও বিক্ষুব্ধ। বহুল আলোচিত ত্বকী হত্যা মামলার খসড়া অভিযোগপত্রের ভাষ্য সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে দিনদুপুরে এ ধরনের হামলা ওই অপরাধীদের বেপরোয়া মনোভাবই স্পষ্ট করে তুলেছে। আমরা মনে করি, এই হামলা কেবল একটি সংবাদপত্রের ওপর নয়; বরং এর মধ্য দিয়ে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরই সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। আমরা এই অঘটনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। পত্রিকাটির সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিকসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও জানাই। যারা সংবাদপত্র কার্যালয়ে অনুপ্রবেশ করে গুলি করে হত্যার হুমকি দিতে পারে, তাদের পক্ষে তা বাস্তবায়নও অসম্ভব হতে পারে না। একই সঙ্গে পত্রিকাটি যাতে ভাঙচুর ও লুটপাটের ক্ষতিপূরণ পায় এবং আহত সাংবাদিকদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়, তাও নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনের।
মন্দের ভালো যে, শনিবার রাত থেকেই পুলিশি অভিযানে হামলাকারীদের আটজন আটক হয়েছে। রোববার তাদের আদালতে তোলা হলে এক দিনের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতিও মিলেছে। আমরা এখন দেখতে চাইব, আইন নিজের গতিতে চলছে। হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় ও সামাজিক প্রভাব এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আটক অবস্থাতেও আদালত এলাকায় তারা যেভাবে সাংবাদিকদের প্রতি হুমকি দিয়েছে, তাও স্পষ্টত ফৌজদারি অপরাধ। এসব অপরাধী সবার গ্রেপ্তার ও বিচার করলেই শুধু চলবে না; তাদের পালের গোদাকেও ধরতে হবে। অন্যথায় এক দল সন্ত্রাসী আইনের হাতে আটক হলেও আরেক দল সন্ত্রাসী সেই শূন্যস্থান দখল করে নেবে। আমরা দেখতে চাইব, নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন ও পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজও এগিয়ে এসেছে। আমরা দেখে থাকি, স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো অনেক সময় এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেখানকার সমাজ ও প্রশাসন থেকে উপযুক্ত সমর্থন ও সহায়তা পায় না। স্থানীয় প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিশ্চুপ থাকে। নারায়ণগঞ্জে এর পুনরাবৃত্তি আত্মঘাতী হতে পারে।
মনে রাখতে হবে- এক সময় 'প্রাচ্যের ডান্ডি' হিসেবে পরিচিত এই বাণিজ্যিক নগরী কীভাবে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে; এই হামলা তার একমাত্র নজির নয়। বস্তুত যে বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে হামলাটি হলো, সেই অভিযোগপত্র 'খসড়া' হয়ে থাকার মধ্য দিয়েও সন্ত্রাসীদের খুঁটির জোর স্পষ্ট। আমাদের মনে আছে, ২০১৩ সালের মার্চ মাসে মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছিল। শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে তার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের পর গ্রেপ্তার এক আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিল, কীভাবে এই সম্ভাবনাময় তরুণকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে উঠে এসেছিল নারায়ণগঞ্জের সাবেক (প্রয়াত) একজন সংসদ সদস্যের পুত্র ও বর্তমান একজন সংসদ সদস্যের ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম। হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় এর তদন্তে নিয়োজিত র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক সংস্থাটির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওই মূল হোতার নাম প্রকাশ করেছিলেন। তার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ঘাতক দল ত্বকীকে হত্যা করে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। দুর্ভাগ্যবশত, গত ৭ বছরেও সেই 'শিগগিরই' শেষ হয়নি।
এখন দেখা যাচ্ছে, ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের খসড়ার ভাষ্য প্রকাশের কারণেই হামলার শিকার হতে হয়েছে একটি সংবাদপত্রকে। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া অগ্রসর না হওয়ার কারণেই সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন প্রশাসন ও পুলিশের উচিত হবে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রটি যত দ্রুত সম্ভব আদালতে দাখিল করা। অন্যথায় সন্ত্রাসীরা যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকবে, তেমনই আরও অনেক ত্বকী থাকবে ঝুঁকি ও হুমকির মুখে। কেবল নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজনে নয়; দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বার্থেই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে।
মন্তব্য করুন