বৃষ্টির দিনে কাঁচা রাস্তায় হাঁটু পর্যন্ত কাদা মেখে আমরা দল ধরে স্কুলে যেতাম। প্রাথমিক বিদ্যালয় অবশ্য বাড়ির পাশেই ছিল। ‘হাই স্কুল’ থেকে আমরা এ হন্টনে যুক্ত হতাম। আমাদের গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের স্কুল ছিল তিন মাইল দূরে। ঘণ্টাখানেক হেঁটে স্কুলে যেতাম। তাতে অবশ্য ক্লান্তি ছিল কিন্তু কষ্ট ছিল না। আনন্দ ছিল, দুঃখ ছিল না। গান গেয়ে হইচই করে দল ধরে আমরা স্কুলে যেতাম। ফিরতাম। আমাদের চলতি পথ আনন্দের ছিল। ভীতির নয়। 

ফিরতি পথে ক্লান্তি চেপে বসলে কত ফন্দি-ফিকির করতাম। রাস্লার পাশে গরু চরানো দেখলে বলতাম- গরু ভাই গরু ভাই একটা গুঁতা দাও। গরু গুঁতা মারতে এলে ভয়ে দিতাম দৌড়; তাতে পথ কিছুটা কমত। কিন্তু বেশির ভাগ গরু পরিচিত ছিল বলে তাড়া জুটত না। তাই হাঁটতেই হতো। হাঁটার ছিল নানারকম ফের। হেলেদুলে হাঁটা, আলসে হাঁটা, ঘুমিয়ে হাঁটা, জোরে হাঁটা, দৌড়ে হাঁটা। ছিল আরও হরেক রকম হাঁটা। আজ আর নামও সব মনে নেই। তবে একজন অন্যজনের গায়ে নিজের ভর কিছুটা কমিয়ে ঠেস দিয়ে হেঁটে আসতাম। ওই হাঁটাটার নাম ছিল ঠ্যাসা হাঁটা। প্রতি জানুয়ারিতে এই হাঁটাহাঁটিতেও আমাদের আনন্দ এসে জুটত; ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা নতুনদের হাঁটার কৌশল শেখানোর মাস্টারি করার সুযোগ থাকত বলে।

চলতি পথে দু’পাশের বাড়িতে থাকা গৃহস্থ বাড়ির বউ, মেয়েদের সঙ্গেও ছিল আমাদের সখ্য। অনায়াসে গল্প করতে পারতাম। উদার, সহনশীল সেসব মা, চাচি, ভাবি, গ্রাম্য বোনদের পেতাম অনায়াসে। চৈত্র মাসের গরমে মাঠে খেতে বসা কৃষক চাচারাও ডাকত আমাদের- এই পানি খেয়ে যা। কিংবা বয়স্ক কোনো চাচি, দাদি আদরে গলা নামিয়ে ডাকত আমাদের- মণি তোরা বারান্দায় উঠে বয়। বৃষ্টি কমলে যাস। ঝড় কমলে যাস। আমরা হইহই রইরই করে অন্যের ঘরের বারান্দায় উঠে পড়তাম ঝুমবৃষ্টিতে।  

নবান্নে কোমরে আঁচল গুঁজে বাড়ির বউ, মেয়েদের ধান মাড়াই করা দেখা ছিল ছবির মতো সাজানো দৃশ্য।  ফিরতি পথে বৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়া এসব কৃষকের মাড়াই করা ধান আমরা দল ধরে ঘরে উঠিয়ে দিতাম। একসঙ্গে  ভিজতে ভিজতে বাড়ি আসতাম। এই যে দল ধরে থাকা, তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। ছেলে-মেয়ে বলে আলাদা হইনি। গ্রামের পথে হেঁটে যেতে যেতে মারামারি ঝগড়া করাতেও কখনও কোনোটাতেই বাধা আসেনি। বর্ষায় আচমকা ঝুমবৃষ্টি এলে আমরা বই বাঁচাতে একাট্টা হতাম। সবার বই ওড়নায় পেঁচিয়ে মাথায় নিয়ে চলে আসতাম।  

স্কুলব্যাগ নেওয়ার চল ছিল না বলে কাঁখে করে বই নেওয়ার বিশেষ পদ্ধতিতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আচমকা বৃষ্টি এলে তাই বড়দের ওড়না পেঁচিয়ে বই বাঁচানোর সে চেষ্টায় ছেলেমেয়ে সবাই এক হয়েছি। পাঁচজনের বই একসঙ্গে করে ওড়নায় বেঁধে পালা করে মাথায় নিয়ে বাড়ি এসেছি। এমনও হতো ওড়না যার তার ভাগের বই আমরা পালা করে নিয়ে তাকে সুবিধা দিয়েছি।

ওড়না আর হিজাবের বাড়াবাড়ি ছিল না বলে বরই, তেঁতুল, কামরাঙা, হরীতকী ভাগাভাগির সুবিধাটা ওড়নাওয়ালারাই সব সময় পেত। গায়ের ওড়না খুলে মাটিতে বিছিয়ে বরই, তেঁতুল, জাম কুড়িয়ে জমা করা ছিল সাধারণ ঘটনা। ভাগাভাগিতে ওড়নার মালিক একটু বেশি পাবে- এ ছিল অলিখিত নিয়ম। তখন ওড়না পরে নিজেকে আড়ষ্ট করার চিন্তা আমাদের গ্রাম্য মাথায় ছিল না। বরং সুবিধা পাওয়ার সে লড়াইয়ে ছেলে বšুব্দদের হিংসা মারামারিতে গড়াতে সময় লাগত না। কাল থেকে ওড়না নিয়ে আসব- ছেলেদের এমন হুমকিতে আমরা সে ঝগড়া মেটাতাম।

তখন বোরকাতেও বাড়াবাড়ি ছিল না। এই তোর ওড়না কই, চাচি তোমার বোরকা কই- এসব বলা বখাটে ছিল না। আমরা জানতামই না ওড়নায় নিজেকে ঢেকে রাখার কৌশল। আমরা জানতাম তিন মাইল পথ হেঁটে যাওয়া মাথার রোদ ঠেকাতে ছাতা টানা বড় কষ্ট। আমরা মাথায় রোদ ঠেকাতে ওড়না টেনে নিতাম। বিকেলের ফিরতি পথের রোদ কখনও কখনও চড়া তাপ বিলালে চাঁদোয়ার মতো ওড়না মাথায় লাইন ধরে বাড়ি ফিরতাম। আমরা ওড়নাকে পেয়েছিলাম সুবিধার চাদর হিসেবে।

ত্রিশ বছর আগে আমরা যত আধুনিক ছিলাম এখন তার সিকি ভাগও নেই। উদারতা নেই। পোশাকের স্বাধীনতা নেই। বন্ধুত্ব নেই। ধর্মের সহাবস্থান নেই। হিন্দু বন্ধুদের পুজাতে যাওয়ার তাড়াও নেই। হিন্দু বন্ধুরাও নেই। কমে গেছে সংখ্যায়। ত্রিশ বছর আগের অভাবী বাংলাদেশের রংধনু ছিল। আজকের ধনী বাংলাদেশে তা নেই। রংহীন।

বিষয় : ফারহানা লাকী সমাজের চিত্র রুপান্তরিত বাংলাদেশ

মন্তব্য করুন